সমাজ মনোবিজ্ঞানের গবেষণায় ব্যবহৃত পদ্ধতিগুলো

সমাজ মনোবিজ্ঞান মনোবিজ্ঞানের একটি উল্লেখযোগ্য শাখা। সমাজ মনোবিজ্ঞান সমাজস্থ মানুষের আচরণ সম্পর্কিত বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা করে থাকে। মানুষ কীভাবে আচার-আচরণ করে, মনোভাব পোষণ করে, কীভাবে প্রত্যক্ষ করে, পরস্পরের ভাব বিনিময় করে, সামাজিক পরিবেশ পরিস্থিতি সবই সমাজ মনোবিজ্ঞান আলোচনা করে। আর সমাজ মনোবিজ্ঞানে সামাজিক মানুষের আচরণ, মানসিক প্রক্রিয়া, ব্যক্তির ওপর সামাজিক প্রভাব বিশ্লেষণ করার জন্য যেসব পদ্ধতি বা কৌশল ব্যবহার করা হয় , জরিপ, পরীক্ষণ, অন্তর্দর্শন-পদ্ধতি অন্যতম।

সমাজ মনোবিজ্ঞানে ব্যবহৃত পদ্ধতি 

সমাজ মনোবিজ্ঞানকে একটি স্থায়ী লাগসই ও বিজ্ঞানসম্মত বিজ্ঞান হিসেবে গড়ে তুলতে সমাজ মনোবিজ্ঞানীরা নিরন্তর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এজন্য বিভিন্ন সমাজ মনোবিজ্ঞানী তাদের গবেষণা কাজে বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করেন। এসব পদ্ধতির মধ্যে বেশ কিছু অন্যতম পদ্ধতি নিম্নে বর্ণনা করা হলো-

১. অন্তর্দর্শন-পদ্ধতি: 

প্রত্যেক মানুষ অন্তর্দর্শনের মাধ্যমে তার নিজের মানসিক জগতে কী ঘটছে তা সোজাসুজি জানতে পারে। মানসিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে জ্ঞানলাভের জন্য যখন ব্যক্তি নিজের মানসিক প্রক্রিয়াকে জানে এবং তার ভাষায় অন্য কারো কাছে তা হুবহু ব্যক্ত করে তাকে ঘটনার অন্তর্দর্শন-পদ্ধতি বলে; অর্থাৎ, যে প্রক্রিয়ায় কোনো ব্যক্তি তার নিজের অভিজ্ঞতা পরীক্ষা করে নিরপেক্ষ বা প্রায়োগিক ভাষার সাহায্যে গবেষকের কাছে তার অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করে তাকে অন্তর্দর্শন-পদ্ধতি বলে। এটি মনোবিজ্ঞানের সুপ্রাচীন পদ্ধতি।

২. পর্যবেক্ষণ-পদ্ধতি: 

পর্যবেক্ষণ-পদ্ধতি মনোবিজ্ঞানিক গবেষণার জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি। বহু পূর্ব থেকেই মনোবিজ্ঞানের গবেষণায় পর্যবেক্ষণ-পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এমন কতগুলো আচরণ ও মানসিক প্রক্রিয়া যা গবেষণাগারে তৈরি করা যায় না, সে আচরণ বা ঘটনা সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে প্রাকৃতিক পর্যবেক্ষণ-পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়ে থাকে; অর্থাৎ, পর্যবেক্ষণ এমন একটি অনুসন্ধান-প্রক্রিয়া যেখানে উদ্দেশ্যমূলকভাবে কোনো বিষয় বা ঘটনার সামনে উপস্থিত হয়ে প্রত্যক্ষভাবে তথ্য সংগ্রহ করা হয়।

৩. পরীক্ষণ-পদ্ধতি: 

মনোবিজ্ঞানের বৈজ্ঞানিক চরিত্র অর্জন করা সম্ভব হয় পরীক্ষণ-পদ্ধতির সাহায্যে। মনোবিজ্ঞানে ব্যবহৃত পদ্ধতির মধ্যে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ও নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি হলো পরীক্ষণ-পদ্ধতি এবং এ পদ্ধতিকে অধিক বিজ্ঞানসম্মত বলে মনে করা হয়ে থাকে। একই সাথে অধিকাংশ মনোবিজ্ঞানী অন্যান্য যেকোনো পদ্ধতির চেয়ে এ পদ্ধতিই বেশি ব্যবহার করে থাকেন, কারণ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির যে সকল বৈশিষ্ট্য তার সব বৈশিষ্ট্য পরীক্ষণে বিদ্যমান, অর্থাৎ, পরীক্ষণ হলো এমন একটি অবস্থা যেখানে কেউ দুটি চলের মধ্যকার সম্পর্ক নির্ণয়ের জন্য একটির মধ্যে ইচ্ছাকৃতভাবে পরিবর্তন এনে দেখেন অন্যটির মধ্যে এর কোনো প্রভাব পড়ে কিনা।

৪. চিকিৎসা-পদ্ধতি: 

মনোবিজ্ঞানে ব্যবহৃত একাধিক পদ্ধতির মধ্যে চিকিৎসা-পদ্ধতি অন্যতম। মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত ব্যক্তিদের শনাক্ত করার জন্য এই পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়। চিকিৎসামূলক পদ্ধতির সাহায্যে প্রধানত মানুষের উপযোজনমূলক আচরণের সমস্যাবলির ওপর অধ্যয়ন করা হয়। এই পদ্ধতির মাধ্যমে ব্যক্তির সামাজিক ব্যাধির কারণ ও স্বরূপ জানা সহজ হয় এবং একই সাথে তার প্রতিকারের ব্যবস্থা করাও সম্ভব হয়। এই পদ্ধতির প্রয়োগক্ষেত্র খুবই বিস্তৃত। এজন্য মনোবিজ্ঞানিগণ ব্যক্তির অতীত ইতিহাস, পরিবার, বন্ধু-বান্ধব, চাকরির বা কাজের ক্ষেত্রগুলোও অনুসন্ধান করে থাকেন।

৫. পরিসংখ্যান-পদ্ধতি: 

সমাজ মনোবিজ্ঞান কিংবা মনোবিজ্ঞানে পরিসংখ্যান-পদ্ধতির কাজ হলো সংগৃহীত তথ্যগুলো প্রক্রিয়াজাত করতে সাহায্য করা এবং তথ্যের বিশ্লেষণ করা। প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণের জন্য গড়, মধ্যমা, প্রচুরক, আদর্শবিচ্যুতি, গড়বিচ্যুতি, শতমিক বিন্দু, শতমিক ক্রম প্রভৃতি পরিসংখ্যানিক পরিমাপ ব্যবহার করা হয়।

৬. সামাজিক জরিপ-পদ্ধতি: 

তথ্যানুসন্ধানের অতি জনপ্রিয় এবং বহুল ব্যবহৃত পদ্ধতি হলো জরিপ-পদ্ধতি। এ কৌশলে তথ্য উদ্‌ঘাটনমূলক, ব্যাখ্যামূলক ও পরীক্ষণমূলক তথ্য সংগ্রহ করা যায়। এ পদ্ধতিতে অংশগ্রহণকারীদের পরিচয়, সম্পদ, চাহিদা, ব্যবস্থা, সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করে গঠনমূলক কর্মসূচি গ্রহণ ও মূল্যায়ন করা যায়। জরিপ-পদ্ধতির জন্য মৌলিক বা লিখিত প্রশ্নপত্র ব্যবহার করা হয়। একই প্রশ্নের যাতে পুনরাবৃত্তি না-ঘটে এজন্য সতর্কতার সাথে প্রশ্নপত্র তৈরি ও মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে।

৭. ঘটনা অনুধ্যান-পদ্ধতি: 

সামাজিক সমস্যার উন্মেষ ও বিকাশ সম্পর্কে জানার ক্ষেত্রে সামাজিক, চিকিৎসা ও আচরণ বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঘটনা অনুধ্যান-পদ্ধতির ব্যবহারও বিস্তৃতি লাভ করেছে। এর প্রধান লক্ষ্য হলো নির্দিষ্ট সমস্যার স্বরূপ উন্মোচন করে তার সুষ্ঠু সমাধান-পরিকল্পনায় সম্যক সাহায্য করা। এ কারণে তুলনামুলক আচরণ, চিকিৎসা ও সমাজ বিষয়ে প্রায়োগিক প্রয়োজনে এর ব্যবহার যথেষ্ট সমাদৃত হয়েছে। এটি সমাজ-গবেষণার একটি তথ্য অনুসন্ধান-কৌশল ও পদ্ধতি হিসেবে খ্যাত।

৮. ক্ষেত্রঅনুসন্ধান-পদ্ধতি: 

এ পদ্ধতিতে অধিক সংখ্যক জনগণের বা গোষ্ঠীবদ্ধ লোকের পরিবর্তে একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায় বা একজন ব্যক্তির ওপর গবেষণা বা পরীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণ সীমাবদ্ধ রাখা হয়। এ পদ্ধতিতে গবেষক যে বিশেষ গোষ্ঠীর সদস্যদের সামাজিক আচরণ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেন তাদের সাথে সরাসরি কিংবা প্রত্যক্ষ যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার জন্য নির্বাচিত গোষ্ঠীর মধ্যে তিনি তার প্রয়োজনমতো স্বল্প বা দীর্ঘকাল বসবাস করে তথ্য সংগ্রহ করে থাকেন।

৯. সাক্ষাৎকার-পদ্ধতি: 

সামাজিক গবেষণায় তথ্য সংগ্রহের যতগুলো পদ্ধতি রয়েছে তার মধ্যে সাক্ষাৎকার-পদ্ধতি অন্যতম। এ 'প্রতিতে পরীক্ষক একটি সাক্ষাৎকারমালা বা কাঠামোবদ্ধ প্রশ্নপত্রের সাহায্যে নিয়ে থাকেন। সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে গবেষক উত্তরদ। নিজ কিংবা তার পরিবার, সমাজ কিংবা দেশের সঠিক ঘটমান বিভিন্ন বিষয়ে জানতে চান এবং তথ্য সংগ্রহ-কাজ সম্পূর্ণ করেন।

১০. প্রশ্নমালা-পদ্ধতি: 

এ পদ্ধতিতে তথ্য সংগ্রহের জন্য ঘটনা বা নির্বাচিত বিষয়বস্তুর ওপর কতকগুলো প্রাসঙ্গিক ধারাবাহিক প্রশ্নপত্র প্রস্তুত করা হয়। বহু সংখ্যক লোক যারা বিচিত্রি ধরনের এবং বিস্তৃত অঞ্চলজুড়ে অবস্থিত তাদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহের জন্য প্রশ্নপত্র প্রবর্তন করা হয়। প্রশ্নমালাপদ্ধতিকে লিখিত সাক্ষাৎকার-পদ্ধতিও বলা হয়। এজন্য গভেষক সরাসরি মাঠপর্যায়ে প্রশ্নমালা নিয়ে উপস্থিত হন বা ডাকযোগে প্রশ্ন পাঠিয়ে দিতে পারেন।

উপসংহার: 

উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সমাজ মনোবিজ্ঞান গবেষণার জন্য একাধিক পদ্ধতির প্রয়োগ রয়েছে। তথ্য সংগ্রহের এসব পদ্ধতি মনোবিজ্ঞানকে একটি বিজ্ঞান হিসেবে দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছে। কেননা প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের পদ্ধতিতে। যেসব নিয়ম অনুসরণ করা হয় তার প্রায় সবই সমাজ মনোবিজ্ঞানে মেনে চলা হয়। এসব পদ্ধতি ঘটনা বা বিষয়বস্তু অনুসারে সুবিধামতো গবেষক যেকোনো একটি পদ্ধতি ব্যবহার করে তার গবেষণাকাজ পরিচালনা করে থাকেন।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url