সমাজ মনোবিজ্ঞানের ক্ষেত্রসমূহ
সমাজ মনোবিজ্ঞান মনোবিজ্ঞানের একটি শাখা। যে সকল বিজ্ঞান মানুষের আচরণ নিয়ে পর্যালোচনা করে সমাজ মনোবিজ্ঞান তাদের মধ্যে অন্যতম। সমাজ মনোবিজ্ঞান মানুষের সামাজিক আচরণ নিয়ে আলোচনা করে। সমাজ একজন অপরকে কীভাবে প্রত্যক্ষণ করে, কীভাবে মতবিনিময় করে, ব্যক্তির উপর সামাজিক পরিস্থিতি এবং কৃষ্টির প্রভাব প্রভৃতি নিয়ে মনোবিজ্ঞানের যে শাখা আলোচনা করে তাকে সমাজ মনোবিজ্ঞান বলে।
সমাজ মনোবিজ্ঞানের ক্ষেত্রসমূহ
সামাজিক আচরণ বা মানুষের পারিস্পরিক সম্পর্কের সকল দিক এবং সামাজিক বিষয়ের সাথে সম্পর্কযুক্ত যে কোনো আচরণ যা ব্যক্তির উপস্থিতি বা অনুপস্থিতিতে বিদ্যমান এসবই সমাজ মনোবিজ্ঞানের বিষয়বস্তুর অন্তর্গত। এছাড়া ব্যক্তির উপর দলের প্রভাব এবং দলগত আচরণের বিভিন্ন দিক সমাজ মনোবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়। এছাড়া সমাজ মনোবিজ্ঞান যেসব বিষয়ে আলোচনা করে। তা নিম্নে উল্লেখ করা হলো:
১. সামাজিক আচরণ পর্যালোচনা:
মানুষের সামাজিক আচরণ পর্যালোচনা করা সমাজ মনোবিজ্ঞানের প্রধান আলোচ্য বিষয়। আমরা কিভাবে অন্যকে প্রত্যক্ষণ করি, কিভাবে একে অন্যের সাথে ভাব বিনিময় করি এবং সামাজিক বিভিন্ন পরিস্থিতি কিভাবে আমাদের প্রভাবিত করে- এসবই সমাজ মনোবিজ্ঞানের অন্তর্গত বিষয়। তাছাড়া ব্যক্তির উপর দলের প্রভাব এবং দলগত আচরণের বিভিন্ন দিকও সমাজ মনোবিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
২. সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া:
সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া সমাজ মনোবিজ্ঞানের একটি জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া। ব্যক্তি কিভাবে সামাজিক আচরণ শিখে ব্যক্তির মনোভাব কিভাবে গড়ে উঠে, ব্যক্তির উপর সামাজিক পরিবেশের প্রভাব কতটুকু, জনমতের চাপে ব্যক্তির বিচারবুদ্ধি কিভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় এবং সামাজিকীকরণের মাধ্যম ও ফলাফল, ব্যক্তির উপর কৃষ্টির প্রভাব প্রভৃতি বিষয় নিয়ে সমাজ মনোবিজ্ঞান আলোচনা করে।
৩. সামাজিক শিক্ষণ:
সমাজ মনোবিজ্ঞানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তুর মধ্যে সামাজিক শিক্ষণের ভূমিকা অনেক। কারণ শিক্ষণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মানব আচরণ ও ব্যক্তিত্ব পরিবেশের সাথে সংগতি বিধানে সক্ষম হয়। তাই শিক্ষণের বিভিন্ন দিক নিয়ে সমাজ। মনোবিজ্ঞান আলোচনা করে থাকে।
৪. ব্যক্তিত্ব:
মানব সম্পর্কিত আলোচনার সর্বপ্রধান দিক হলো ব্যক্তিত্ব। তাই ব্যক্তিত্ব সমাজ মনোবিজ্ঞানের বিষয়বস্তুর অন্তর্ভুক্ত। মূলত ব্যাক্তিত্ব হলো ব্যক্তির অভ্যন্তরীণ আচরণের এমন একটি বাহ্যিক প্রকাশ যা তার সম্পর্কে অন্য মানুষের মনে ইতিবাচক বা নেতিবাচক ধারণার জন্য দেয়। ব্যক্তিত্বই ব্যক্তিত্ব চিন্তা ও মননের মূল চালিকাশক্তি। এ কারণে সমাজ মনোবিজ্ঞানে ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব, ব্যক্তিত্বের স্বরুপ, ব্যক্তিত্বের উপাদান, ব্যক্তিত্বের ধরন ও বিকাশ এবং ব্যক্তিত্বের উপর সংস্কৃতির প্রভাব প্রভৃতি বিষয় নিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনা করে।
৫. ব্যক্তির মনোভাব:
সমাজ মনোবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ব্যক্তির মনোভাব। মনোভাব মানুষের ব্যক্তিত্বের গভীরে নিবিড়ভাবে প্রোথিত এবং বিশেষ ভঙ্গিতে আচরণ করার একটা স্থায়ী প্রবণতাস্বরূপ। সমাজের নানা বিষয়ে প্রত্যেক ব্যক্তিরই ভিন্ন ভিন্ন মনোভাব থাকতে পারে। ব্যক্তির এসব মনোভাব কিভাবে গড়ে উঠে, কিভাবে মনোভাবকে পরিবর্তন করা যায় এবং মনোভাবকে কিভাবে পরিমাপ করা যায় তা সমাজ মনোবিজ্ঞান ব্যাপকভাবে আলোচনা করে থাকে।
৬. নেতৃত্বের বিভিন্ন দিক:
মানবিক আচরণের একটি বিশেষ দিক হচ্ছে নেতৃত্ব। তাই সমাজ মনোবিজ্ঞান সামাজিক মানবিক বিজ্ঞান হিসেবে ব্যক্তিত্বের নানা দিক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে থাকে। এসব দিকের মধ্যে রয়েছে নেতৃত্বের প্রকৃতি, ফলপ্রসূ নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্য, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নেতৃত্বের ভূমিকা প্রভৃতি।
৭. গবেষণা পদ্ধতি:
সমাজ মনোবিজ্ঞান ব্যক্তির আচরণ এবং ব্যক্তির উপর সামাজিক প্রভাব পর্যালোচনা করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন পদ্ধতি প্রয়োগ করে থাকে। যেমন-পর্যবেক্ষণ, ক্ষেত্র অনুধ্যান, প্রশ্নমালা, জরিপ এবং পরীক্ষণ পদ্ধতি ইত্যাদি। এসব পদ্ধতি প্রয়োগ করে গবেষকগণ মানুষের সামাজিক আচরণের যেকোনো বিষয়ের উপর গবেষণা করতে পারেন। তবে এক্ষেত্রে চলকের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার এবং সকল প্রকার নিরাপত্তা বিধান নিশ্চিত করতে হবে।
৮. কৃষ্টির প্রভাব:
মানৰ আচরণে কৃষ্টি তথা সংস্কৃতি গভীর প্রভাব বিস্তার করতে পারে। তাই এটি সমাজ মনোবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষর। কৃষ্টি ও ব্যক্তিত্ব পরস্পর গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। বৃষ্টি সদা পরিবর্তনশীল। সুতরাং কৃষ্টি কিভাবে একজন ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব গঠনে সাহায্য করে সমাজ মনোবিজ্ঞান তা আলোচনা করে। সমাজ মনোবিজ্ঞানী ও নৃবিজ্ঞানীদের গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশের ক্ষেত্রে কৃষ্টির ভূমিকা উল্লেখযোগ্য।
৯. মৌলিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সম্বন্ধ:
সমাজ মনোবিজ্ঞান ব্যক্তির মৌলিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সম্বন্ধেও আলোচনা করে। সমাজ মনোবিজ্ঞানী কিম্বল ইয়ং বলেন, "সমাজ মনোবিজ্ঞান তিনটি মৌলিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সম্বন্ধে আলোচনা করে। যথা-ব্যক্তিতে- ব্যক্তিতে সহ্য, ব্যক্তিতে-গোষ্ঠীতে সম্বন্ধ এবং গোষ্ঠীতে-গোষ্ঠীতে সম্বল।" মানুষের পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি ও আচরণ যা মানুষকে প্রভাবিত করে সবই সমাজ মনোবিজ্ঞানের অন্তর্গত বিষয়বস্তু।
১০. দল সম্পর্কীয়:
একাধিক ব্যক্তির সমাবেশকে তখনই দল বলা যায় যখন সদস্যবৃন্দের মধ্যে পারস্পরিক আদান-প্রদান হয়। সমাজ মনোবিজ্ঞানের বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে দল ও দলীয় প্রক্রিয়াকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণভাবে চিহ্নিত করা হয়। দলের বৈশিষ্ট্য, দলের প্রকারভেদ, নেতার কার্যাবলি, নেতৃত্বের প্রকারভেদ, সফল নেতার গুণাবলি ইত্যাদি বিষয় নিয়েও সমাজ মনোবিজ্ঞানিগণ পর্যালোচনা করে থাকেন।
১১. সামাজিক প্রত্যক্ষণ:
সামাজিক প্রত্যক্ষণের বিষয়টিও সমাজ মনোবিজ্ঞানে গুরুত্বের সাথে আলোচিত হয়। কেননা মানব আচরণ গঠনে প্রত্যক্ষণের ভূমিকা অনেক। প্রত্যক্ষণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই আমরা পৃথিবীয় যাবতীয় বস্তু, অবস্তু এবং সামাজিক প্রপঞ্চ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা লাভ করি।
১২. সামাজিক প্রেষণা:
সমাজ মনোবিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি বিষয় হলো প্রেষণা। বিভিন্ন ধরনের প্রয়োজন বা অভাববোধ থেকেই মানুষের মধ্যে প্রেষণার উদ্ভব হয়। এ প্রয়োজন বা অভাববোধ হতে পারে জৈবিক কিংবা সামাজিক। প্রেষণা মানুষকে কর্মে তাড়িত করে। মানুষের এসব প্রেষণার মধ্যে কোনো কোনো প্রেষণা যন্ত্র সময়ের জন, মানুষের মনে কর্মস্পৃহা জাগ্রত করে আবার কোনোটি সারা জীবনের কর্মস্পৃহা জোগায়।
১৩. বংশগতির প্রভাব:
একটি সামাজিক ও মানবিক বিজ্ঞান হিসেবে সমাজ মনোবিজ্ঞান বংশগতির প্রভাব নিয়ে আলোচনা করে। কারণ বিভিন্ন রকম প্রথা-ঐতিহ্য, আচার-ব্যবহার, নৈতিকতার অনুশীলন, অনুষ্ঠান-প্রতিষ্ঠান প্রভৃতি যা ব্যক্তি সামাজিক উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করে সেগুলো ব্যক্তির আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে।
১৪. গুজব সংক্রান্ত:
সমাজ মনোবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো গুজব। এটি মানুষ ও তার চিন্তাধারাকে এবং বিভিন্ন কাজের ধারাকে লক্ষণীয়ভাবে পরিবর্তন করে থাকে। মানুষ কেন গুজব ছড়ায়? কিভাবে গুজবের মাধ্যমে নিজের অবচেতন মনের দুশ্চিন্তা, ভয়, ইচ্ছা প্রভৃতি প্রতিফলিত হয়? কিভাবে প্রচারণার বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যায়?-এসবই সমাজ মনোবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু।
১৫. জনমত:
জনমত হচ্ছে জনতার মতামত। গণতান্ত্রিকতায় বিশ্বাসী কোনো সমাজে বা রাষ্ট্রে জনমত একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। ডুবের মতে, "একটি বিষয় সম্বন্ধে কতকগুলো লোকের মতামতই হচ্ছে জনমত।" জনমত প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য উভয়ই হতে পারে। সুতরাং জনমত কিভাবে গড়ে উঠে, জনমত গঠনের মাধ্যম, জনতার আচরণ ব্যাখ্যা, গুজব ও পূর্বসংস্কার সম্পর্কে সমাজ মনোবিজ্ঞান বিস্তারিত আলোচনা করে।
১৬. যোগাযোগ:
মানুষ সামাজিক জীব। সমাজে মানুষ একে অপরের সাথে মিলেমিশে বসবাস করে। আর মানুসের পারস্পরিক ক্রিয়া বা আন্তঃক্রিয়ার মাধ্যমেই সামাজিক আচরণ ও পারস্পরিক সম্পর্কের বিকাশ ঘটে। এই আস্তারিয়ার অন্তর্নিহিত পক্রিয়াটির নামই হলো যোগাযোগ। ভাষা যোগাযোগের সর্বপ্রধান মাধ্যম। ভাষার সাথে মানুষের চিন্তন ও কৃষ্টির একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে। সুতরাং যোগাযোগের কারণ কি, এর প্রয়োজনীয়তা কি এসব বিষয়ের সুশৃঙ্খল আলোচনা সমাজ মনোবিজ্ঞানে হয়ে থাকে।
উপসংহার:
উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সমাজ মনোবিজ্ঞান সামাজিক মানুষের মানবিক আচরণ সম্পর্কিত একটি বিজ্ঞান। এর বিষয়বস্তু হচ্ছে সামাজিক পরিবেশের পটভূমিতে ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব এবং তার আচরণের পর্যালোচনা। এটি একটি গতিশীল বিষয় বলে এর বিষয়বস্তু দিন দিন বেড়েই চলেছে। সমাজ মনোবিজ্ঞানের সফল প্রয়োগের ফলেই কলুষিত সমাজব্যবস্থাকে ঢেলে নতুনভাবে সাজানো সম্ভব হচ্ছে। বিভিন্ন সামাজিক অপরাধ দূর করে সুশৃঙ্খল সমাজ গঠনে সমাজ মনোবিজ্ঞান উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে চলেছে।