বাংলাদেশে মনোবিজ্ঞান-চর্চার সমস্যা ও সম্ভাবনা
বাংলাদেশে মনোবিজ্ঞান জৈব সামাজিক বিজ্ঞানের অন্যতম শাখা হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজ পর্যায়ে পঠিত হচ্ছে। ১৯২১ সাল থেকে শুরু করে পঞ্চাশের দশকের শেষ পর্যায় পর্যন্ত বিষয়টি দর্শনের অংশ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ১৯৫৬ সালে মনোবিজ্ঞান একটি আলাদা বিভাগ হিসেবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৯৬৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন থেকে আলাদা হয়ে মনোবিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়।
স্বতন্ত্র বিভাগ হিসেবে মনোবিজ্ঞানের বিকাশ
১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির সময়ও মনোবিজ্ঞান দর্শনের আওতাভুক্ত ছিল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠার কয়েক বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতন মনোবিজ্ঞান গবেষণাটিকে নতুনভাবে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেয়া হয়। ১৯৬৪ সালে দর্শন এবং মনোবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক ড. মীর ফখরুজ্জামান আমেরিকার আইওয়া (University of lowa) থেকে পিএইচডি ডিগ্রি সম্পন্ন করে দেশে ফেরেন এবং ১৯৬৫ সালে তাঁর নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠা হয়। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (গোপালগঞ্জ) ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক স্বতন্ত্র বিভাগ হিসেবে মনোবিজ্ঞানের একাডেমিক কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
বাংলাদেশে মনোবিজ্ঞান-চর্চার সমস্যা ষাটের দশকে একাডেমিক কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে মনোবিজ্ঞানের অধ্যয়ন শুরু হয়। মনোবিজ্ঞানের অধ্যয়নের কয়েক যুগ পার হয়ে গেলেও নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে পেশাগত চর্চা নানা সমস্যায় জর্জরিত। নিম্নে মনোবিজ্ঞান-চর্চার সমস্যাসমূহ আলোচনা করা হলো-
১. স্বীকৃত মানদণ্ডের অভাব:
প্রতিটি পেশার একটি স্বীকৃত মানদণ্ড থাকে। কিন্তু মনোবিজ্ঞানের সুনির্দিষ্ট স্বীকৃত মানদণ্ড বা সুপারভিশন কমিটি নেই। তাই মনোবিজ্ঞানের পেশাদারিত্বের বিকাশ রুদ্ধ হয়ে আছে।
২. সক্রিয় পেশাগত সংগঠনের অভাব:
বাংলাদেশে মনোবিজ্ঞানের সক্রিয় পেশাগত সংগঠন নেই বললেই চলে। বাংলাদেশ মনোবিজ্ঞান সমিতি অনেক পুরাতন হলেও এটি মনোবিজ্ঞানের একাডেমিক ও প্রায়োগিক উভয় দিকে নজর দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। বাংলাদেশ মনোবিজ্ঞান সমিতির প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৬ সালে। মনোবিজ্ঞানের চর্চার মন্থর গতির জন্য রাংলাদেশ মনোবিজ্ঞান সমিতিও দায় এড়াতে পারে না।
৩. মনোবিজ্ঞান ও মানসিক স্বাস্থ্য-সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব:
মনোবিজ্ঞান সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে তেমন কোনো ধারণাই নেই। অসুস্থতা বলতে সাধারণ শারীরিক অসুস্থতাকে বুঝে থাকে।
৪. পেশাদার দক্ষ মনোবিজ্ঞানীর অভাব:
মনোবিজ্ঞানের প্রয়োগ ও চর্চার বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন এই বিষয়ের উপর ডিগ্রিধারী ব্যক্তিবর্গের। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, এ বিষয়ে ডিগ্রিধারীদের অনেকেই মনোবিজ্ঞানে কাজ করতে অনীহা প্রকাশ করে। আবার অনেকে উচ্চতর ডিগ্রির জন্য বিদেশে গিয়ে আর দেশে ফিরে আসে না। পেশাদার দক্ষ মনোবিজ্ঞানীর অপ্রতুলতাও মনোবিজ্ঞান পেশার বিকাশে অন্তরায়।
৫. সমন্বয়ের অভাব:
সমন্বয়হীনতা পেশাগত মনোবিজ্ঞানের বিকাশের জন্য আর একটি বিরাট বাধা; যেমন- ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি/কাউন্সেলিং সাইকোলজির কর্মপরিধি প্রায় কাছাকাছি। আবার কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে দুরকম পাঠ্যসূচি।
৬. প্রশিক্ষণের অভাব:
পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ একজন পেশাজীবীকে স্বীয় কাজে দক্ষ করে তোলে। কিন্তু আমাদের দেশে মনোবিজ্ঞানীদের জন্য তেমন কোনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও নেই। অনেকে ডিগ্রি অর্জন করে কয়েকটা ওয়ার্কশপ করে নিজেকে মনোবিজ্ঞানী ভাবা শুরু করে। এই ধরনের নবীন মনোবিজ্ঞানীদের জন্য মনোবিজ্ঞানের প্রতি মানুষের আস্থা তৈরি হচ্ছে না।
৭. বই ও প্রকাশনার অপ্রতুলতা:
মনোবিজ্ঞান-চর্চার অন্যতম হাতিয়ার হলো বই। কিন্ত মনোবিজ্ঞানের বইয়ের সংখ্যা খুবই নগণ্য। ড. মীর ফখরুজ্জামান ও নিহাররঞ্জন সরকার বাংলায় মনোবিজ্ঞানের পুস্তক রচনার পথপ্রদর্শনের ভূমিকা পালন করেন। রওশন আলী, মুসলিম হুদা, আব্দুল খালেক, হামিদা আক্তার বেগম, আফসার উদ্দিন, ড. আকরাম উজ্জামান, ড. নূর মোহাম্মাদ প্রমুখ মনোবিজ্ঞানিগণ বাংলায় মনোবিজ্ঞানের বই রচনা করে মনোবিজ্ঞানচর্চাকে ত্বরান্বিত করেন।
৮. গবেষণার অভাব:
এদেশে মনোবিজ্ঞানের গবেষণা হয়েছে খুব কম। অথচ মনোবিজ্ঞানে পেশাগত মর্যাদা পাওয়ার জন্য গবেষণা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। গবেষণা মনোবিজ্ঞানচর্চার প্রাণ। গবেষণা ও প্রশিক্ষণের অভাবে মনোবিজ্ঞান-পেশা বর্তমানে সমস্যার সম্মুখীন।
বাংলাদেশে মনোবিজ্ঞান-চর্চার সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায়
বাংলাদেশে মনোবিজ্ঞান-চর্চার উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমানে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণি থেকে স্নাতক, স্নাতকোত্তর, এমফিল, পিএইচডি প্রভৃতি শ্রেণিতে মনোবিজ্ঞানের উপর পাঠদান করা হচ্ছে। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের জন্য ইন্টার্ন, ট্রেনিং, সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এর ফলে শিক্ষার্থীরা মনোবিজ্ঞানের সঠিক জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি, মনোবিজ্ঞানের জ্ঞানকে বাস্তবে প্রয়োগ করার সুযোগ পাচ্ছে। কিন্তু এদেশে মনোবিজ্ঞানের উপর উচ্চশিক্ষা নিয়েও শিক্ষার্থীরা কর্মক্ষেত্রে তাদের অর্জিত জ্ঞানকে কাজে লাগাতে পারছে না। এ ধরনের অবস্থা মনোবিজ্ঞান শিক্ষার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশে মনোবিজ্ঞান চর্চার সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে:
- উপযুক্ত প্রশিক্ষণের সুবিধা তৈরি করা
- পেশাদারিত্ব বৃদ্ধি করা
- সাংগঠনিক তৎপরতা বৃদ্ধি করা
- সরকারি সহায়তা বৃদ্ধি করা
- স্কলারশিপের ব্যবস্থা করা
পরিশেষে বলা যায়, উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে মনোবিজ্ঞান নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছে। পাশাপাশি এর কিছু সম্ভাবনাও রয়েছে। তবে এই প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করতে পারলে নিকট ভবিষ্যৎকালে মনোবিজ্ঞানের চর্চার পথ সুগম হবে।