চিকিৎসা-পদ্ধতি হিসেবে মনঃসমীক্ষণ
অস্ট্রিয়ার মোরাভিয়ার (বর্তমানে চেকোশ্লোভভাকিয়ার অন্তর্ভুক্ত) ১৮৫৬ সালের ৬ মে প্রখ্যাত মনোবিজ্ঞানী Sigmund Freud (1856-1939) জন্মগ্রহণ করেন। বিজ্ঞানী হিসেবে নিজেকে তৈরি করতে গিয়ে Freud যে মতবাদ উপস্থাপন করেন সেটাই মনঃসমীক্ষণ মতবাদ (Psychoanalytic theory)। আসলে মনঃসমীক্ষণ ছিল Freud-এর একটি মনোচিকিৎসা-পদ্ধতি। Freud প্রথমে স্নয়ুতন্ত্রের উপর শিক্ষা লাভ করেন এবং স্নায়ুবিদ হিসেবে কাজ শুরু করেন। স্নায়ুতন্ত্রের প্রতি আগ্রহই তাকে মানসিক ব্যাধির চিকিৎসায় উদ্বুদ্ধ করে। প্রথম দিকে Freud মনঃসমীক্ষণ-পদ্ধতিতে মানসিক রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা করতেন এবং পরবর্তীকালে তিনি মনঃসমীক্ষণের মাধ্যমে মানুষের আচরণ ও ব্যক্তিত্বের ব্যাখ্যা প্রদানে প্রয়াসী হন। তাই মনঃসমীক্ষণ একাধারে একটি চিকিৎসা-পদ্ধতি এবং একটি মতবাদ।
মনঃসমীক্ষণ চিকিৎসা-পদ্ধতির লক্ষ্য
মনঃসমীক্ষণ এপ্রোচে কাউন্সেলিংয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ হয় ক্লায়েন্ট অনুসারে।
- ক্লায়েন্টকে জীবনের অচেতন বিষয়গুলির সম্পর্কে সচেতন হতে সাহায্য করে।
- বিকাশমূলক পর্যায়ে অপূরণীয় বিষয়গুলো পূরণে সহায়তা করা এবং ব্যক্তিত্বের আত্মোন্নয়নে সাহায্য করা।
- ব্যক্তি যে সমাজে বাস করে সেই সমাজের চাহিদা অনুযায়ী নিজেকে খাপ খাইয়ে চলতে সাহায্য করে।
- এটা ব্যক্তির উপলব্ধি ও পরিকল্পনাগুলো আরো বাস্তবসম্মত করতে অহং (Ego)-কে শক্তিশালী করতে সাহায্য করে।
মনঃসমীক্ষণ চিকিৎসা-পদ্ধতির কৌশলসমূহ
ফ্রয়েডীয় মনঃসমীক্ষণ এপ্রোচে মূল পাঁচটি কৌশল হলো-
১. মুক্ত অনুষঙ্গ-পদ্ধতি (Free association method):
মুক্ত অনুষঙ্গ মনঃসমীক্ষণ-প্রক্রিয়ার একটি কেন্দ্রীয় কৌশল। মুক্ত অনুষঙ্গ-পদ্ধতিতে ক্লায়েন্টের মনে যা আসে তা বলতে উৎসাহ দেওয়া হয়। সেগুলো কতটা কষ্টকর, সামান্য, অপ্রযোজনীয়, অযৌক্তিক বা অপ্রাসঙ্গিক তা বিবেচনা করা হয় না। এটা ক্লায়েন্টের অবচেতন ইচ্ছা, কল্পনাসমূহ, দ্বন্দ্ব এবং তাড়না প্রকাশের দরজা খুলে দেয়। কাউন্সেলর ক্লায়েন্টের কথাগুলো শোনেন, তার বাদ পড়ে যাওয়া কথাগুলো চিহ্নিত করার চেষ্টা করেন এবং ব্যক্তি কথাগুলোর লুকায়িত অর্থ বের করার চেষ্টা করেন। মুক্ত অনুষঙ্গ পদ্ধতিতে কাউন্সেল ক্লায়েন্টের অন্তর্দৃষ্টি বাড়ানোর চেষ্টা করেন।
২. স্বপ্নের বিশ্লেষণ (Dream Analysis):
স্বপ্ন বিশ্লেষণ মনঃসমীক্ষণের একটি চিরায়ত কৌশল, যার সাহায্যে থেরাপিস্ট রোগীকে তার স্বপ্নগুলো স্মরণ করতে এবং পরে তা বিশ্লেষণ করতে সহায়তা করেন। 'স্বপ্ন' একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম যা ব্যক্তির অচেতন বিষয়গুলি প্রকাশ করে। স্বপ্নের বিষয়বস্তু ২ ধরনের হতে পারে, যথা:
- Manifest content: স্বপ্নের ব্যক্তরূপ, যা ব্যক্তির মনে ছদ্মবেশে থাকে তাকে Manifest content বলে।
- Latent content: স্বপ্নের অন্তর্নিহিত, সুপ্ত বা অব্যক্তরূপই হলো Latent content যা ব্যক্তির অচেতন কামনার প্রতিরূপ।
৩. অভিসঞ্চালনের বা স্থানান্তরের বিশ্লেষণ (Analysis of transference):
কাউন্সেলিং চলাকালে ক্লায়েন্ট ও কাউন্সেলরের মধ্যকার সম্পর্ক জটিল আকার ধারণ করতে পারে এবং তাদের ভেতর আবেগমূলক আসক্তি তৈরি হতে পারে। অভিসঞ্চালন-প্রক্রিয়া ক্লায়েন্ট কাউন্সেলরকে তার অতীত কোনো সম্পর্কের প্রতীক (পিতা, মাতা, ঘনিষ্ঠ আপনজন) মনে করে তার অনুভূতিগুলোকে ইতিবাচক বা নেতিবাচকভাবে ব্যক্ত করে। অনুভূতিগুলোকে এভাবে প্রকাশ করাকে Emotional Cathersis বলে। অভিসঞ্চালন দুধরনের হতে পারে, যথা-
- ধনাত্মক অভিসঞ্চালন: যখন ক্লায়েন্টর প্রেম, প্রীতি, ভালোবাসা প্রভৃতির ইতিবাচক আবেগসমূহ চিকিৎসকের প্রতি সঞ্চালিত হয় তখন তাকে ধনাত্মক অভিসঞ্চালন (Positive Transference) বলা হয়।
- ঋণাত্মক অভিসঞ্চালন: ক্লায়েন্টের বিদ্বেষ ও বিরাগবোধ চিকিৎসকের প্রতি সঞ্চালিত হলে তাকে ঋণাত্মক অভিসঞ্চালন (Negative Transference) বলে।
৪. প্রতিবন্ধকতা বিশ্লেষণ (Analysis of resistance):
রোগীর চিকিৎসা-প্রক্রিয়ায় কোনো রূপ বাধা তৈরি করণে তাকে প্রতিবন্ধকতা (Resistance) বলা হয়; অর্থাৎ, মনঃসমীক্ষণে অচেতন মনের বহিঃপ্রকাশ রোধ করাই প্রতিবন্ধকতা। মাঝে মাঝে মনঃসমীক্ষণের মাধ্যমে যখন সেশন পরিচালনার মাধ্যমে অগ্রগতির এক পর্যায়ে এসে ক্লায়েন্ট তার অচেতন মনের বহিঃপ্রকাশকে আস্তে আস্তে কমিয়ে দেয় বা বন্ধ করে দেয়। আর চিকিৎসামূলক প্রক্রিয়ায় এর অনেক কারণ থাকতে পারে; যেমন- সাক্ষাৎকারে অনুপস্থিত থাকা, মুক্ত অনুষঙ্গের সময় চিন্তাগুলোকে জমাটবদ্ধ করে রাখা, অচেতন মনের বহিঃপ্রকাশ না-করা, স্বপ্ন পুনরুৎপাদন অস্বীকার করা বা অতীত স্মৃতিগুলো স্মরণে আনতে অসমর্থ হওয়া। যখনই ক্লায়েন্ট অচেতন মনের বহিঃপ্রকাশকে রোধ করে তখন কাউন্সেলর তাৎক্ষণিকভাবে এই বিষয়কে দূর করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন।
৬. ব্যাখ্যাকরণ (Interpretation):
ব্যাখ্যাকরণকে উপর্যুক্ত চারটি কৌশলে পরিপূরক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ব্যাখ্যাদান-প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কাউন্সেলর ক্লায়েন্টের যেসব অবদমিত বিষয় প্রকাশ হয় তখন সেগুলোর ব্যাখ্যা প্রদান করে থাকেন। ব্যাখ্যাদান-প্রক্রিয়ার কাউন্সেলর ক্লায়েন্টের অতীত ও বর্তমান ঘটনার ব্যাখ্যাকরণের মাধ্যমে উপলব্ধি তৈরি করে অন্তর্দৃষ্টি অর্জনে সহায়তা করে থাকেন।
তবে অন্য আরো একটি কৌশলের কথা উল্লেখ করেছে কিছু গবেষক। তা হলো নিরাসক্ততা (Detachment)। Gerald Corey মনঃসমীক্ষণ-প্রক্রিয়ায় একটি নির্দিষ্ট কাঠামো বজায় রাখা (Maintaining analytic Framework)-এর উপর জোর দিয়েছেন। সুনির্দিষ্ট কাঠামো বজায় রাখা বলতে তিনি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করেছেন; যেমন মনঃসমীক্ষকের নামহীনতা, নিয়মিত এবং সামঞ্জ্যপূর্ণ সেশন পরিচালনা, যথাসময়ে সেশনের সূচনা ও সমাপ্ত করা প্রভৃতি।