বিবাহ বিচ্ছেদ প্রতিরোধ
বিয়ে থেকেই বিচ্ছেদের উৎপত্তি। সব ধর্ম বা বর্ণের লোকের কাছে বিবাহবিচ্ছেদ নিকৃষ্ট কাজ। বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের পর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সন্তান। তাদের নীরব কান্না শোনার বা দেখার সময় কারো নেই।
যেহেতু তারা সুন্দর, স্বাভাবিক জীবনে বড় হতে পারে না, পরবর্তী জীবনেও তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। সন্তান বাবা-মা দুজনকে জড়িয়ে নিয়েই বাঁচতে চায়। বাবা-মা দুজন যখন সন্তান দাবী করে সন্তানের করুণ দৃষ্টি, মানবিকগুণ সম্পন্ন সব মানুষকে বেদনা বিধুর করবেই। সমস্যা যেমন আছে, উত্তরণেরও অনেক উপায় আছে।
বিবাহ বিচ্ছেদ প্রতিরোধ
১) পারস্পরিক বোঝাপড়া:
দাম্পত্য কলহের সৃষ্টি হলে প্রথমেই দুজন মিলে তার কারণ চিহ্নিত করে সমাধানের চেষ্টা নিজেদেরই করতে হবে। ব্যক্তি সচেতনতা, সহনশীলতা, সমঝোতা করে বিশ্বাসের ভীত শক্ত করতে হবে। শান্তি, সুখ ও ভালবাসার নীড় সাজানোর জন্য উভয়কে ছাড় দিতে হয়। পরস্পরের প্রতি সহনশীলতা, বিশ্বস্ততা, শ্রদ্ধা বোধ থাকা জরুরি।
২. নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন:
নারীর প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন ব্যতীত বিবাহ বিচ্ছেদ বন্ধ করা সম্ভব নয়। কারণ নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন আইন প্রণয়ন করে করা যাবে না। এর জন্য প্রয়োজন নারীর প্রতি পুরুষের সংবেদশীল মনোভাব। যেসব দেশ নারীর প্রতি ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে সে সব দেশে নারী পুরুষের মধ্যে বৈষম্য হ্রাস পেয়েছে। ফলস্বরূপ বিবাহ বিচ্ছেদের হারও কমেছে। নারীর প্রতি ইতিবাচক পরিবর্তন আনার জন্য সমাজের সচেতন জনগোষ্ঠী, নারী সমাজ ও গণমাধ্যম সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।
৩. পারিবারিক সম্প্রীতি বৃদ্ধি:
পারিবারিক সম্প্রীতির অভাব বিবাহ বিচ্ছেদের একটি অন্যতম প্রধান কারণ। অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি, তথ্য প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসারের ফলে আমাদের দেশে পরিবারগুলোতে আধুনিকতার ছোয়া লাগতে শুরু হয়েছে। যার ফলে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে মায়ামমতা, স্নেহ ভালবাসা আজ কমতে শুরু করেছে। একজন, অপরজনের প্রতি অসহিষ্ণু মনোভাব পোষণ করছে। কেউ কাউকে এতটুকু ছাড় দিতে নারাজ। যার ফলে বিবাহ বিচ্ছেদের মতো অমানবিক ঘটনার বেড়ে যাচ্ছে।
৪. বিবাহ এবং বিবাহ বিচ্ছেদের নিবন্ধন ডিজিটালাইজেশন:
অনেকেই আইনবিধি নিয়ম-কানুনের ধারে কাছে না গিয়ে নোটিশ গোপন করে ৯০ দিন পর বিবাহবিচ্ছেদের ঘোষণা নিচ্ছেন। অনেকে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে, নোটারী পাবলিকের কার্যালয়ে বেআইনি, নিয়মবহির্ভূতভাবে তালাক প্রদান করছে। বর্তমানে ডিজিটাল বাংলাদেশে বিয়ে ও তালাক দুটোরই ডিজিটালাইজেশন জরুরি। এতে কারও বিয়ে হলে অনলাইন যেমন জানতে পারবে, বিচ্ছেদ হলেও অনলাইনে বিষয়টি অবহিত করা জরুরি। তাতে করে প্রতারিত হওয়ার মাত্রা কমে যাবে যা নারী পুরুষ দুপক্ষের জন্যই মঙ্গলজনক ও কল্যাণকর।
৫. রাষ্ট্রের ভূমিকা:
বিবাহ বিচ্ছেদ প্রতিরোধে রাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। কারণ রাষ্ট্র হলো সমাজের সবচেয়ে শক্তিশালী সংগঠন। আর যে কোনো ব্যাপারে রাষ্ট্রের কথাই হলো চূড়ান্ত। তাই রাষ্ট্র এমন আইন প্রণয়ন করতে পারে যা বিবাহ বিচ্ছেদ প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। রাষ্ট্র আইনের যথাযথ প্রয়োগ করে বিবাহ বিচ্ছেদ রোধে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। রাষ্ট্র বিবাহ বিচ্ছেদ প্রতিরোধে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি করে দিতে পারে।
৬. সচেতনতা বৃদ্ধিঃ
বিবাহ বিচ্ছেদ প্রতিরোধ করার ক্ষেত্রে সচেতনতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিবেচিত। সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করার জন্য রাষ্ট্র, এনজিও, মহিলা সংগঠন, গণমাধ্যম প্রভৃতি বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে।
উপসংহার:
পরিশেষে বলা যায় যে, বাবা-মায়ের বিচ্ছেদে অনেক সময় সন্তান হয়ে যায় মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন ও বদরাগী। মানসিক বিষন্নতা ও অবসাদ তাদের আচ্ছন্ন করে রাখে। বনিবনা হবে না জেনে কেন সন্তান ধারণ করা? সন্তানের সঠিক বিকাশের জন্য বাবা মা দুজনকেই প্রয়োজন। দুজনের নির্মল স্নেহ ভালবাসা পেতে তাদের হৃদয় উন্মুখ থাকে। ব্রোকেন ফ্যামিলির সন্তানদের দুঃখ-বেদনা ভুক্তভোগী ছাড়া আর কেউ জানে না। তাই বিবাহ বিচ্ছেদ প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন।