বৃত্তি নির্বাচনের উপাদানসমূহ

একটি কাজে প্রবেশ করা মানে পেশা নির্বাচন নয়। কিন্তু এটি হচ্ছে এমন একটি পদ্ধতি যার মাধ্যমে ব্যক্তি কাজের সাথে মিলবন্ধন তৈরি করতে পারে। পেশাগত ভূমিকা এবং প্রত্যাশা দ্বারা সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়াকে গতিশীল করে। এখানে প্রশিক্ষণের পদ্ধতি এবং পেশাগত ভূমিকার চাহিদা পুনঃসামাজিকীকরণের একটি নতুন মাত্রা তৈরি করে। সামাজিকীকরণ মাধ্যমগুলো পেশা নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করে থাকে। এ গুলো শিক্ষাবিষয়ক, সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক অভিজ্ঞতাকে বর্ণনা করে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে চাকরির প্রথম দিক থেকেই জাতিগত ও জেন্ডার বৈষম্য নিয়ে প্রভাব শুরু হয়।

বৃত্তি নির্বাচনের উপাদানসমূহ 

এভাবেই বাস্তবে পেশাগত নির্বাচন প্রক্রিয়াটি মূলত চাকরি পাওয়ার অনেক পূর্বেই শুরু হয়। এক্ষেত্রে যেসব বিষয় রয়েছে। সেগুলোকে দুটিভাগে ভাগ করা যায়। যথা- 

ক) সমাজিক উপাদান 

খ) ব্যক্তিগত উপাদান

নিম্নে উপদান সমূহ আলোচনা করা হলো-

ক) সমাজিক উপাদান

সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের যে উপাদানসমূহ পেশা নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করে তাকে সামাজিক উপাদান বলে। যেমন- আর্থ-সমাজিক অবস্থা, শিক্ষার হার, সামাজিক মনোভাব, বিশ্বাস তথা সমাজিক পটভূমি। আবার, সমাজে সফল ব্যক্তি-ব্যক্তিত্বকে অনুসরণ ও অনুকরণ বৃত্তি নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করে।

১. পটভূমি উপাদান: একজন ব্যক্তি পেশা নির্বাচনে কিছু কারণ দ্বারা পরিচালিত হয়ে জটিলতার দিকে ধাবিত হয়। যেমন- 

  • আর্থ-সামাজিক অবস্থা, জাতিগত সংস্কৃতি, জেন্ডার ও বর্ণ। অনেক ক্ষেত্রেই একজন ব্যক্তি এসব বাধাবিঘ্ন পেরিয়ে তার পেশার দুয়ার উন্মোচন করতে পারেন।
  • একজন ব্যক্তির পেশার প্রতি প্রবণতার ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা, ধর্ম বা জাতিগত বা পরিবারের সমর্থন এবং বৈষম্যতা প্রভৃতি মূখ্য ভূমিকা পালন করে। এ বিষয়গুলো শুধু পেশা পছন্দের সময়ই নয় বরং বিয়ের ক্ষেত্রে সঙ্গী পছন্দের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
  • আবার কিছু কিছু পেশার ক্ষেত্রে বিশেষ প্রশিক্ষণ বা লেখাপড়ার প্রয়োজন। যাদের এই প্রয়োজনীয় লেখাপড়া বা প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে তারা উপযুক্ত হিসেবে বিবেচিত হয় না।
  • পেশা নির্বাচনের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেয়াটা দুটি স্তরে থাকে, একটি হল একজন ব্যক্তির বর্তমান প্রস্তুতির মাধ্যমে দক্ষতা অর্জন করে একটি পেশা গ্রহণ। আরেকটি হল ব্যক্তি পেশাগত প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা যা নতুন সম্ভাব্য ভালো পেশাগুলোতে প্রবেশের ক্ষেত্রে সহায়তা করবে।
  • ব্যক্তি এমন একটি পেশায় যেতে চায় যা তাদের পরিবার ও বন্ধুবান্ধবের কাছে গ্রহণযোগ্য অর্থাৎ জাতিগত ধারণা দ্বারা প্রতিঘাত প্রাপ্ত নয়।

২. রোল মডেল: একটি পেশা পছন্দের ক্ষেত্রে, সফল একজন ব্যক্তিকে রোল মডেল করা যায়। এক্ষেত্রে রোল মডেল হল এমন একজন ব্যক্তি যে খুবই সম্মানীয় ব্যক্তি- যার মধ্যে ব্যক্তি নিজেকে খুঁজে পায় এবং ব্যক্তি তার সাথে নিজের তুলনা করে এবং তার মত হতে চায়। প্রায় ক্ষেত্রেই এই রোল মডেলটি আপেক্ষিক হয়। চিরাচরিত সমাজ ব্যবস্থায় একজন ব্যক্তি তার পিতামাতার পদচিহ্ন অনুসরণ করে থাকে। যাহোক; একজন রোল মডেলকে খুঁজে পাওয়া এবং তাকে নির্বাচন করাটা খুবই উপজীব্য হয়। রোল মডেল অনুসরণ করেই একজন কর্মচারী বা দিন মজুরদের ছেলে মেয়েরা বড় হয়ে শিক্ষক বা ডাক্তার হবার স্বপ্ন দেখার সাহস পায়।

খ) ব্যক্তিগত উপাদান

ব্যক্তির অভিজ্ঞতা, আগ্রহ ও ব্যক্তিত্ব প্রভৃতি বৃত্তি নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করে। 

১. অভিজ্ঞতা (Experience): একইভাবে একজন ব্যক্তি তার চাকুরি বা পেশাকে নির্বাচন করার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোন অভিজ্ঞতার

উপর নির্ভর করতে পারে। একজন নারী পুলিশ অফিসার হতে পারে কারণ সে তার বড় ভাইকে দেখেছে সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হতে, যার কারণে সে এই পেশায় আসতে চায়। আবার, ছোটবেলায় প্লেন দিয়ে খেলার সময় শিশুরা পাইলট হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে।

২. আগ্রহ (Interest): প্রত্যেকেরই পেশা নির্বাচনের ক্ষেত্রে নিজের একটি পছন্দ রয়েছে, তবে প্রত্যেকের ব্যক্তিগত আগ্রহ, অগ্রাধিকার এবং মূল্যায়ন এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। সাইকোথেরাপিস্টদের ক্ষেত্রে, পেশাদার ব্যক্তিকে একই আগ্রহের প্রতি মনোভাবাপন্ন সাইকোথেরাপি বিষয় থেকে নিয়ে থাকে। কিন্তু অন্যদিকে এই আগ্রহ ভিন্ন পেশা ও সন্তুষ্ট করতে পারে। সাধারণত, ব্যক্তির আগ্রহও মূল্যায়ন ভিন্নভাবে রোল মডেল এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার প্রতিফলিত করে। এতে আবার ব্যক্তির অনন্য বৈশিষ্ট্য যেমন অতীত কাজের পরিসীমা, বুদ্ধি ও কাজ সম্পর্কে ধারনা প্রতিফলিত হয় (Bolles, 1972; 1988)। তার সর্বাধিক বিক্রিত চাকুরি পরির্তনের চিন্তা বইতে শিব খেরা বলেছেন, আপনার লক্ষ্য দক্ষতা অনুযায়ী নিজের একটি পছন্দসই তালিকা তৈরি করতে হবে। তিনি এক্ষেত্রে কয়েকটি প্রায়োগিক দিকের কথা বলেছেন যেগুলোর মধ্যে রয়েছে পূর্বের স্মৃতি, বর্তমান সম্পর্কে অনুভূতি ও ভবিষ্যতের দূরদর্শিতার প্রতিফলন।

৩. ব্যক্তিত্ব (Personality): আবার, কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যক্তি ও চাকুরির মধ্যে মানানসই ব্যাপারটা পেশা পছন্দকে প্রায়ই প্রতিফলিত করে থাকে। কিছু সংখ্যক গবেষণা করা হয়েছে যেখানে দেখা হয়েছে প্রাপ্তবয়স্কদের যেসব ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্য রয়েছে সেগুলো বিভিন্ন ধরনের পেশার সাথে কিভাবে সম্পর্কিত। বিভিন্ন পেশার প্রতি ব্যক্তিত্বের ধরনের সামঞ্জস্যতা রয়েছে।

Holland (1973) ছয়টি সদৃশ ব্যক্তিত্বের ধরন ও পেশার পরিবেশের প্রস্তাব করেছেন। Holland (1976) এগুলো সংক্ষিপ্তভাবে বিবৃত করেন- 

  1. বাস্তবধর্মী (Realistics): এখানে রয়েছে আক্রমনাত্মক আচরণ, শারীরিক কর্মক্ষমতায় প্রয়োজনীয় দক্ষতা, শক্তিমত্তা ও সহযোগিতা (উদাহরণ- পশুপালন, কৃষিকাজ ও চাষ পদ্ধতি)। 
  2. অনুসন্ধান (Investigative): এখানে অনুভূতি কার্যক্রমের (অনুভূতি, অভিনয় অথবা আন্তব্যক্তিগত ও আবেগীয়) তুলনায় জ্ঞানী কার্যক্রম (চিন্তাভাবনা, সংগঠিত হওয়া, বুঝতে পারা) বেশি হয়। (যেমন: জীববিজ্ঞান, গণিত ও সমুদ্রবিজ্ঞান)। 
  3. সামাজিক (Social): এখানে জ্ঞানীয় বা শারীরিক বিষয়ের তুলনায় আন্তব্যক্তিগত বিষয়গুলো বেশি প্রাধান্য পেয়ে থাকে (যেমন- চিকিৎসা মনোবিজ্ঞান, বৈদেশিক সেবা, সমাজকর্ম)।
  4. গতানুগতিক (Conventional): কোন প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিগত চাহিদা অথবা ব্যক্তির শক্তি ও অবস্থার গঠন, নিয়ম- নিয়ন্ত্রিত কার্যক্রম ও নিয়মানুবর্তিতা। (উদাহরণ: হিসাববিজ্ঞান, অর্থায়ন)
  5. উদ্যমী (Enterprising): শক্তি ও অবস্থার মূল্যায়নে অন্যকে প্রভাবিত করার জন্য মৌখিক ক্রিয়াকলাপ রয়েছে। (উদাহরণ: ব্যবস্থাপনা, আইন)।
  6. শিল্পীসুলভ রুচিসম্মত (Artistics): এর মধ্যে রয়েছে স্ব-প্রকাশ, শিল্প সৃষ্টি, আবেগের প্রকাশ ও ব্যক্তিগত কার্যক্রম (উদাহরণ: কলা, সঙ্গীত, শিক্ষা)।

উপসংহার 

যারা পেশাগত ক্ষেত্রের প্রতি এক পরিস্কার সাড়া খুঁজে পান না তাদের জন্য পেশাগত পরীক্ষাটি খুবই উপযুক্ত। পেশাগত পরীক্ষা হল এমন একটি পরীক্ষা যা একজন ব্যক্তির বিভিন্ন প্রশ্নের প্রতি প্রতিক্রিয়াকে বিভিন্ন ক্ষেত্রের মানুষদের সাধারণ প্রতিক্রিয়ার সাথে তুলনা করে থাকে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url