বিবাহ বিচ্ছেদের বিপত্তিসমূহ
বিবাহ-বিচ্ছেদ নিঃসন্দেহে একটি অস্বাভাবিক ঘটনা এবং পারিবারিক কলহের ফল। এটা যেমন পারিবারিক অশান্তি সৃষ্টি করে তেমনি এর রয়েছে সামাজিক অশান্তি সৃষ্টির ক্ষমতা। তাই বিবাহ-বিচ্ছেদের ফলে যেসব ঘটনা ঘটে তা দুঃখজনক।
বিবাহ বিচ্ছেদ
বৈবাহিক চুক্তি বা বন্ধনের ভাঙন অথবা সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত দাম্পত্য সম্পর্কের পরিসমাপ্তির পন্থা বা প্রক্রিয়ার নাম বিবাহ-বিচ্ছেদ। এরূপ সম্পর্কচ্ছেদ আদালতের মাধ্যমে অথবা স্বামী-স্ত্রীর আপোষের মাধ্যমে হয়ে থাকে।
ওয়েবস্টার অভিধান অনুযায়ী বিবাহ বিচ্ছেদ হলো,
A legal Dissolution in a marriage relation usually by a court or other body having competent authority.
আধুনিক শিল্প-সমাজে বিবাহ বিচ্ছেদের হার সবচেয়ে বেশি। আমরা বিয়ে করতে পছন্দ করি, এমনকি সবাই করে। তারপরও আমাদের সমাজে বিবাহ বিচ্ছেদ বা ডিভোর্সের হার সবচেয়ে বেশি। পাশ্চাত সমাজে বিবাহ বিচ্ছেদ বা ডিভোর্সের হার প্রতি তিন বিবাহের মধ্যে একটি। এই হারটি সত্যিই বিবাহ বিচ্ছেদ বা ডিভোর্সের আসল পরিমাণ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে সঠিক নয়। এটি নির্ভর করে একটি নির্দিষ্ট বছরে মোট বিবাহ বিচ্ছেদ বা ডিভোর্সের সংখ্যা এবং মোট বিবাহের সংখ্যার অনুপাতের উপর। সব বিবাহ বিচ্ছেদই একই বছরে বিবাহিত দম্পতির ক্ষেত্রে ঘটে না। একটি বছরে অসংখ্য বিবাহ বিচ্ছেদ বা ডিভোর্সের ঘটনা ঘটে থাকে। তারপরও অনেক মানুষ বিয়ের জন্য পূর্বেই পরিকল্পনা করে থাকে। এটা ধারণা করা হচ্ছে যে বিবাহ বিচ্ছেদের হার পরবর্তী দশকগুলোতে আরো বাড়বে।
বিবাহ-বিচ্ছেদের প্রভাব
বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য বিভিন্ন প্রকার প্রভাব পরিলক্ষিত হয় নিম্নে তা আলোচনা করা হলো-
১. পরিবার ভেঙে যাওয়া:
পরিবার হলো সমাজের সবচেয়ে ক্ষুদ্র ও প্রাথমিক একক। বিবাহ- বিচ্ছেদের ফলে পরিবার ভেঙে যাচ্ছে। পরিবার ব্যবস্থার মধ্যে যে সামাজিক দায়বদ্ধতা থাকে তা আর থাকছে না। এই পরিবার যখন না টিকবে তখন সমাজ-ব্যবস্থায় অশান্তি ও অনাচার বিরাজ করবে। এই রকম সমাজে মানসিক ভারসাম্যহীনতা, আত্মহত্যা, খুন খারাবি বেড়ে যায়। তাই এখন পরিবার টিকিয়ে রাখার পক্ষে খোদ পশ্চিমা বিশ্বে জোরালো আবেদন সৃষ্টি হচ্ছে। স্লোগান উঠছে পরিবার রক্ষা কর। আর বিবাহ-বিচ্ছেদ রোধই এর উত্তম সমাধান হতে পারে।
২. যৌন সমস্যা:
পুরুষেরা বিবাহ-বিচ্ছেদের পর অনেক সহজেই একজন নারীকে বিবাহ করতে পারে, কিন্তু নারীর পক্ষে দ্বিতীয়বার বিবাহ প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। এর ফলে পুরুষ তাড়াতাড়ি তার স্বাভাবিক যৌনজীবনে ফিরে আসতে পারে, যা নারীর পক্ষে সম্ভব হয় না। ফলে নারীর জন্য বিপথগামী হওয়া বা ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া অস্বাভাবিক নয়। অথচ আমাদের সমাজে এটা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
৩. নতুন প্রজন্ম বিকাশে অসুবিধা:
পরিবারের মাধ্যমে মানুষ পৃথিবীতে আসে। পরিবার না থাকলে যেমন পিতামাতা শনাক্ত করা সম্ভব নয়, তেমনি সন্তানের প্রতি পিতামাতার কোনো দায়বদ্ধতাও থাকছে না। ফলে তাদের ভালো মানুষ হিসেবে সমাজে বিকশিত হওয়ার উপায় থাকছে না। যে সমাজে পরিবারে বন্ধন যত দুর্বল সে সমাজে নতুন প্রজন্মের বিকাশ ততই রোধ হচ্ছে। যেমন সমাজতান্ত্রিক চীনে ১৯৫০-এর দশকে পরিবার ভেঙে দিয়ে তেমন কোনো সুফলের পরিবর্তে যখন কুফল দেখা দিল, তখন তারা আবার পরিবার ব্যবস্থার দিকে ফিরে এলো। তাই দেখা যায় যে ছেলেমেয়েদের সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার জন্য পারিবারিক বন্ধন তথা পিতামাতার সরাসরি সাহচর্য দরকার আর তা কেবল পরিবারের মাধ্যমে সম্ভব। আর এই পরিবার ব্যবস্থাকে ধরে রাখার অন্যতম শর্ত বিবাহ-বিচ্ছেদ ঠেকানো। পিতামাতার বিচ্ছেদ ঘটলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সন্তানরা অসহায়ত্ববোধ করে।
৪. সামাজিক অনাচার বৃদ্ধি:
বিবাহ-বিচ্ছেদ পরিবারকে তো প্রভাবিত করেই সাথে সাথে সমাজকেও কিছুটা কলুষিত করে তোলে। বিবাহ-বিচ্ছেদের ফলে নানা ধরনের সামাজিক অনাচার, যেমন- যৌন ব্যবসা, পরকীয়া, ধর্ষণ, আত্মহত্যার মতো নানা অপকর্ম বৃদ্ধি পায়। এ কারণে এ ধরনের ছোটখাটো ঘটনা সমাজে অনেক বড় দুর্ঘটনাও ঘটিয়ে দিতে সক্ষম হয়। সমাজে কারো বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটলে, উপযুক্ত কোনো পাত্রের বিবাহ না হলে এ ধরনের অসামাজিক কর্মকাণ্ড সংঘটিত হয়ে থাকে।
৫. পুনঃবিবাহ প্রবর্তন:
বিবাহ বিচ্ছেদের ফলে পুনঃবিবাহ সংগঠিত হয়। এর ফলে যেমনি আর্থিক ক্ষতি সংগঠিত হয়, তেমনি যে নতুন মহিলাকে বিবাহ করে আনে সেও তার নতুন স্বামীর মাঝে সুসম্পর্কের ক্ষেত্রে অনেক সময় বাধ সাধে স্বামীর আগের স্ত্রীর সন্তানেরা। এমন অভিযোগ পাওয়া যায় যে সৎ সন্তানের প্রতি সৎ মার আচরণ খুবই নেতিবাচক।
৬. পিতামাতার কষ্ট:
পরিত্যক্ত হয়ে যখন মেয়ে তার পিতামাতার ঘরে ফিরে আসে তখন পিতার জন্য সে অতিরিক্ত বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি তাঁর প্রতি অনেক সময় পিতামাতার আচরণও বেদনাদায়ক হয়ে দাঁড়ায়। আর পিতামাতা গরিব নিম্নবিত্ত হলে তার ভরণপোষণও কষ্টকর হয়ে পড়ে।
৭. দ্বন্দ্ব ও সংঘাত:
আমাদের সমাজে জ্ঞাতিসম্পর্কের স্ত্রী-পুরুষের মাঝে বিবাহের রীতি লক্ষ করা যায়। তাছাড়া পাড়া-প্রতিবেশীদের সাথেও অনেকে ছেলেমেয়ের বিবাহ দিতে আগ্রহ দেখায়। ফলে যখন কোনো কারণবশত বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে তখন ঐ দুটি পরিবার সরাসরি সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। এমনকি এ ধরনের ঘটনাও ঘটে যে বিবাহ বিচ্ছেদকে কেন্দ্র করে সারা গ্রাম সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। কারণ এর সাথে বংশীয় মর্যাদা জড়িত থাকে।
৮. স্ত্রীর নির্মম পরিণতি:
সমাজে তালাকপ্রাপ্ত নারীর বিবাহ দেয়া অত্যন্ত কঠিন একটি কাজ। সাধারণ এ ধরনের মেয়েকে কেউ বিবাহ করতে চায় না। অথবা এমন কোনো সুযোগ এলেও হয়তোবা বরপক্ষ মোটা অঙ্কের যৌতুক দাবি করে বসে, যার জন্য বিপাকে পড়ে তালাকপ্রাপ্ত নারীর বাবা-মা। ফলে তারা বাবা, মা, ভাইয়ের পরিবারে নিগৃহীত জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়। তাছাড়া সমাজও তাদের সুদৃষ্টিতে দেখে না। অতএব বাঙালি সমাজে বিচ্ছেদ নারীর জীবনে একটা অভিশাপস্বরূপ।
৯. সন্তানের দুর্ভাগ্য:
সাধারণত আমাদের সমাজে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে থাকে বিয়ের সাত-আট বছরের মধ্যে। এ সময় সন্তানাদি নাবালক থাকাই স্বাভাবিক। পিতা-মাতার বিচ্ছেদে তারা দিশেহারা হয়ে পড়ে। মানসিকভাবে তারা অস্বাভাবিক হয়ে পড়ে। ফলে পরবর্তী জীবনে পিতামাতার এহেন আচরণ, অবস্থা তাদের জীবনকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে।
১০. দৈনন্দিন জীবনে সমস্যা:
বিবাহ বিচ্ছেদে স্বামী ও স্ত্রী উভয়েই অনেক চাপ ও দুশ্চিন্তামূলক এবং খারাপ অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যায়। এটি আরো পীড়াদায়ক হয় যদি সে পরিবারে সন্তান থাকে। কারণ তখন সকল সমস্যার প্রভাব সন্তানের উপর গিয়ে পড়ে। বিবাহ বিচ্ছেদ ব্যর্থতা, দোষারোপ, বিদ্রোহ, অভিযোগ ইত্যাদির অনুভূতি সৃষ্টি করে এবং অসুস্থতার ও মৃত্যুর উচ্চহার নির্দেশ করে (Kitson & Morgan, 1990)। কিছু কিছু বিবাহ বিচ্ছেদ প্রাপ্ত নারীদের দৈনন্দিন কাজকর্মে জটিলতা দেখা দেয়। বিষণ্ণতা এবং বিশৃঙ্খল চিন্তাভাবনা এবং কাজকর্ম বিবাহ বিচ্ছেদের পর বেশি দেখা যায়।
উপসংহার:
পরিশেষে বলা যায়, একটি সুন্দর সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টির জন্য যে কোনো মূল্যেই বিবাহ বিচ্ছেদ প্রতিরোধ দরকার। আর তাতে আমরা যত বেশি সক্ষম হবো সামাজিক সুফল তত বেশি দেখা দিবে।