ব্যক্তিত্বের উপর মেনোপেজের প্রভাব

মহিলাদের 'ঋতুস্রাব' বন্ধ হওয়ার সময়কে ঋতুবন্ধ বা মেনোপজ বলে। মেনোপজ হল একটি জৈবিক প্রক্রিয়া যা একজন মহিলার প্রজনন ক্ষমতার পরিসমাপ্তি নির্দেশ করে। এটি সাধারণত ৫০ বছর বয়সের কিছুটা আগে ও পরে ঘটে। যদিও সঠিক বয়স ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হতে পারে। মেনোপজকে সেই সময় হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয় যখন একজন মহিলার টানা ১২ মাস ধরে মাসিক হয় না। মেনোপজের সময় ঘটে যাওয়া মূল হরমোনের পরিবর্তনগুলির মধ্যে ডিম্বাশয় দ্বারা ইস্ট্রোজেন এবং প্রোজেস্টেরনের উত্পাদন হ্রাস পায়।

একজন নারী ঋতুবন্ধ বা মেনোপজ প্রতি কেমন ধারণা পোষণ করছেন তা নির্ভর করে তার মূল্যবোধ, মনোভাব ও আচরণ এবং তার নিজস্ব পরিবেশে ও পরিস্থিতির উপর। একজন নিঃসন্তান নারীর ক্ষেত্রে ঋতুবন্ধ বা মেনপেজ মাতৃত্বের সম্ভাবনা একেবারেই ধূলিসাৎ করে দেয়। অন্যদিকে যে নারীর সন্তান রয়েছে এবং যে সন্তান প্রতিপালন করে বড় করেছেন তিনি ঋতুবন্ধ বা মেনোপেজকে যৌন স্বাধীনতা এবং উপভোগের সুযোগ হিসেবে দেখে (Avis, 1999)। 

ব্যক্তিত্বের উপর মেনোপেজের প্রভাব 

নিম্নে ব্যক্তিত্বের উপর মেনোপেজের প্রভাব আলোচনা করা হলো-

১. মানসিক বিপত্তি: 

কিছু মানসিক সমস্যা, যেমন- বিরক্তি, উদ্বিগ্নতা, বিষণ্ণতা, স্মৃতিভ্রম ইত্যাদি বিষয়গুলোর জন্য এ সংকটকালীন সময়কে দায়ী করা হলেও গবেষণায় এর কোনো ভিত্তি পাওয়া যায়নি (LKachman, 2004; Whitbourne, 2001)। শরীরের তাপবৃদ্ধি, ঘেমে যাওয়া, বিরক্তি ঘুম না হওয়া বা ইনসমনিয়া, কষ্টকর যৌন সঙ্গম ইত্যাদি সমস্যাগুলো বিভিন্ন মহিলাদে মাঝে দেখা গেছে (Rossi, 2004)। মেনোপজ বা ঋতুবন্ধর ফলে বিষণ্ণতা সৃষ্টি হয় এমন ধারণার পিছনে নারীদের পরিবর্তিত ভূমিকা, সম্পর্ক ও দায়িত্ব প্রভাব বিস্তার করে। কেননা এ বিষয়গুলো নারীর ক্ষেত্রে যদি পীড়নমূলক হয়ে থাকে তবে মেনোপেজের লক্ষণে তা প্রভাব ফেলতে পারে (Avis, 1999; Lachman, 2004; Rossi, 2004)। যে সকল নারী ঋতুবন্ধ বা মেনোপেজকালে অস্বস্তিত্বে ভোগের তাদের পূর্ব ইতিহাসে দেখা যায় যে মাসিক ঋতুস্রাবকালীন সময়ে তারা অধিক ব্যথা অনুভব করতো, পরিবেশগত ও অন্তর্গত বিষয়গুলোর প্রতি উচ্চমাত্রা সংবেদনশীল ছিল এবং কর্মক্ষেত্র কিংবা বাড়িতে তারা উচ্চ মাত্রায় পীড়নমূলক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতো (Rossi, 2004)।

Avis (1999) এর গবেষণায় দেখা গেছে মেনোপজের লক্ষণগুলো ব্যক্তির ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য, কিংবা তার অতীতের অভিজ্ঞতা দ্বারা প্রবাবিত। সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাবও একটি নিয়ামক হিসেবে কাজ করে, যেমন- যে সংস্কৃতিতে মেনাপজকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করা হয় কিংবা বৃদ্ধ মহিলারা সামাজিক, ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী, সে সমাজের এই প্রাকৃতিক ঘটনাকে ঘিরে খুব সামান্যই অসুবিধা হয়।

২. আত্ম-প্রত্যয়: 

পশ্চিমা সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও মহিলাদের মধ্যবয়সের পরিবর্তনগুলোর মাঝে ঋতুবন্ধ খুব বেশি বড় পর্যায়ে যায়নি (Neugarten. Wood, Kraines & Loomis. 1963)। অর্ধেক মধ্যবিত্ত মহিলারা, যাদের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছিল এই গবেষণায়, মনে করেছিল যে ঋতুবন্ধ তেমন কোন ঘটনাই না। তারা যুবতী মহিলাদের মত মনে করেন যে ঋতুবন্ধ তাদের জীবনে বড় কোন পরিবর্তন ঘটায় নি, লক্ষণগুলোর উপর তুলনামূলক নিয়ন্ত্রণ আছে এবং তা অবশ্যই সংকটপূর্ণ অভিজ্ঞতা নয়। "বুড়ো হয়ে যাওয়া", "শক্তির স্বল্পতা", "খারাপ স্বাস্থ্য বা অসুস্থতা" মধ্যবয়সিদের জন্য অত্যন্ত সাধারণ অভিযোগ। খুব কম মহিলাই ঋতুবন্ধর সাথে এই পরিবর্তন এর সম্পর্ক করতে পারে। সবচেয়ে খারাপ হলো এটা না জানা যে, তারা কোন ধরনের ব্যাথা বা অস্বস্তির সম্মুখীন হতে যাচ্ছেন এবং বুড়ো হয়ে যাওয়ার ইঙ্গিতগুলো। 

৩. লিঙ্গ বিষয়ক দুশ্চিন্তা হ্রাস: 

বেশির ভাগই মনে করে যে যৌন সম্পর্ক অথবা শারীরিক বা মানসিক স্বাস্থ্যের উপর ঋতুবন্ধ (Menopause)র কোন প্রভাব নেই। তিন-চতুর্থাংশ মহিলা ঋতুবন্ধ (Menopause) সম্পর্কে "ভাল কিছু" রিপোর্ট করেছিলেন যে এতে গর্ভধারণের দুশ্চিন্তাও করতে হয় না আবার ঋতুস্রাবের চিন্তাও করতে হয় না (Neugarten. Wood, Kraines & Loomis.1963)।

৪. চেহারার আকর্ষণীয়তা হ্রাস: 

অর্ধেক মনে করে যে, মহিলাদের চেহারার উপরে এটি নেতিবাচক পভাব ফেলে। ডিম্বাশয়ের হরমোন উৎপাদিত না হওয়া ও কিছু গ্রন্থিগত পরিবর্তনের কারণে চুল সাদা হতে থাকে, গলার স্বর মোটা হয়ে যায় এবং চেহারার লাবণ্যতা কমতে থাকে। ব্যক্তিভেদে এটি মোকাবেলা করার ক্ষমতাও প্রতীয়মান হয়। যদিও কিছু উত্তরদাতা বড় ধরনের অস্বস্তির কথা বলেছেন কিন্তু ঋতুবন্ধর গুরুত্ব স্বীকার করেছেন এবং কেউ কেউ এর বিপরীত বলেন। সর্বোপরি উত্তরদাতারা ঋতুবন্ধ নিয়ে আলোচনা করতে বেশ আগ্রহী ছিলেন যেহেতু ঋতুবন্ধ (Menopause) মহিলাদের জন্য সামাজিক সাহায্যের ব্যবস্থা ছিলনা (গর্ভবতী মহিলাদের জন্য সাহায্যের তুলনায়) এবং তারা এই ব্যাপারে আরও তথ্য জানতে আগ্রহী ছিলেন। উত্তরদাতারা আরো নির্দেশ করেছিলেন যে, ঋতুবন্ধর একটি সামাজিক চাহিদা রয়েছে যে এটিকে একটি সংকটময় সময় হিসেবে দেখতে হয়, যেহেতু তারা মনে করতেন তারা নিজেরা যতটা অনুভব করছেন "অন্যান্য মহিলারা" এটিকে আরও নেতিবাচকভাবে দেখতো।

৫. সামাজিক বিরূপ মনোভাব: 

উনিশ শতকের শুরুতে পশ্চিমা সংস্কৃতিতে ঋতুবন্ধ বা মেনপেজকে একটি রোগ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। ধারণা করা হতো ডিম্বাশয়ের স্বাভাবিক কার্যপ্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটার ফলে ঋতুবন্ধ বা মেনপেজ হয়ে থাকে। কিছু কিছু সংস্কৃতিতে ঋতুবন্ধ বা মেনপেজকে অবহেলার দৃষ্টিতে দেখা হয়। তবে, ভারত এবং দক্ষিণ ২. এশিয়ার বিভিন্ন সংস্কৃতিতে ঋতুবন্ধকে একটি স্বাগতমমূলক ঘটনা যা নারীর সামাজিক অবস্থান এবং স্বাধীনতাকে বৃদ্ধি করে (Avis, 1999; Lock, 1994)।

উপসংহার: 

বর্তমানে অনেক নারীরা ঋতুবন্ধ বা মেনোপজকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেন। কেননা ঋতুবন্ধ বা মেনপেজ বয়ঃপ্রাপ্তির দ্বিতীয়ার্ধে পদার্পনের নির্দেশকস্বরূপ যা ব্যক্তির ভূমিকা পরিবর্তন, অধিক স্বাধীনতা এবং ব্যক্তিগত উন্নয়নের সাথে জড়িত। MIDUS অধ্যয়নে অধিকাংশ নারী ঋতুবন্ধ বা মেনপেজর পরিবর্তনের সময়কে স্বস্তিদায়ক হিসেবে বিবেচনা করেন (Rossi, 2004)।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url