কুবলার রস এর মৃত্যু প্রক্রিয়ার পাঁচটি স্তর
মৃত্যু সম্পর্কিত ধারণা নিয়ে ব্যক্তিভেদে যে ভীতি কাজ করে তা আমরা পূর্বেই জেনেছি। তবে যারা মৃত্যু-প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যান এবং মৃত্যুর নিশ্চয়তা বিষয়ে অবগত থাকেন তাদের অভিজ্ঞতার ব্যাপারটি নিয়ে একটি বহুল আলোচিত গবেষণা প্রথম প্রকাশ করেন Elisabeth Kubler Ross (1969)। তিনি একজন মনোচিকিৎসক যিনি কয়েকশ' মৃত্যুপথযাত্রী রোগীর পর্যবেক্ষণ ও সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন।
কুবলার রস এর মৃত্যু প্রক্রিয়ার পাঁচটি স্তর
তিনি মৃত্যু-প্রক্রিয়ার পাঁচটি ধাপের কথা উল্লেখ করেছেন, যেখানে প্রতিটি ধাপ নির্দিষ্ট কিছু আচরণ দ্বারা বিশিষ্ট।
প্রথম ধাপ - অস্বীকার:
প্রথম ধাপটি হলো অস্বীকার করা, যেখানে ব্যক্তির আচরণে সত্যকে অস্বীকার বা গ্রহণ না করার প্রবণতা দেখা যায়, যেমন- 'এটা হতে পারে না', 'আমার সাথে এমন হবে না' ইত্যাদি। এই ক্ষেত্রে প্রায়শই দেখা যায় আসন্ন মৃত্যুকে অবহেলা করা হয় কিংবা গুরুত্বহীনতার সাথে বিষয়টি বিবেচনা করা হয়। কিছু রোগী এবং তাদের ভালোবাসার মানুষের ক্ষেত্রে অস্বীকারকে রক্ষণশীল উপাদানসমূহের মধ্যে চরম আকার ধারণ করে।
অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর ধারণাকে বাধাগ্রস্ত করা হয় এবং সচেতন মনে এ ধারণার প্রবেশ অস্বীকার করা হয়। সেই সাথে বিপরীত ধারণাকে গ্রহণ করা হয়, যেমন- আমি মারা যাচ্ছি না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রোগী অবশ্যম্ভাবী লক্ষণগুলোকেও অস্বীকার করে থাকেন, যেমন- আমার শ্বাস নিতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। লক্ষণ এবং এর প্রয়োগসমূহের মাঝে যোগসূত্র অস্বীকার ভেঙে ফেলে, যেমন- আমার শ্বাস নিতে কিছুটা অসুবিধা হচ্ছে তবে এটা কিছু না। কিছু ক্ষেত্রে লক্ষণগুলো মেনে নিলেও রোগী নিজেকে ব্যতিক্রম মনে করেন, যেমন- ফুসফুসের ক্যান্সারের চিকিৎসা না করা হলেও সবসময় তা মৃত্যু বয়ে আনে না (Weisman, 1972)।
মৃত্যুপ্রক্রিয়া পুরোপুরি অস্বীকার করা কিছু সময় এবং কিছু ক্ষেত্রে একেবারেই স্বাভাবিক। আরো একটি সাধারণ বিষয় হলো মৃত্যুপথযাত্রী ব্যক্তির সামনে কিংবা তার সচেতন অবস্থায় মৃত্যু সম্পর্কিত কথাবার্তা না বলা। সামাজিক প্রথা অনুযায়ী রোগীর সাথে তার কাছের মানুষ, ডাক্তার কিংবা নার্স কেউই বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। 'মৃত্যু' তাই একটি নিষিদ্ধ বিষয় হয়ে ওঠে এবং কেউই রোগের লক্ষণ এবং এর ভবিষ্যৎ পরিণতি বিষয়ে কথা বলার অনুমতি পায় না। এ নিয়ম যদিও কেউ ভঙ্গ করে (যেমন, হঠাৎ কেঁদে দিল) তবে সে ব্যক্তিকে অবহেলা করা হয় এবং অন্যান্য বিষয়ের আলোচনাগুলো অধিক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, যেমন- আবহাওয়ার অবস্থা, হাসপাতালের খাবারের মান, হাসপাতালের পরিবেশে কীভাবে ঘুমাতে হবে ইত্যাদি আলোচনা অক্ষুণ্ণ থাকে (Glaser and Strauss, 1965)।
যদিও মানবতার দিকে লক্ষ্য রেখে মৃত্যু এবং এ সম্পর্কিত আলোচনা অবদমন করে রাখা হয় তথাপি এটি উপলব্ধি করতে হবে যে কারো অনুভূতির অবদমন স্বাস্থ্যকর অবলম্বন নয় (Glaser and Strauss, 1965)। অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর বিষয়টি যদি খোলামেলাভাবে আলোচনা করা যায় তবে রোগী এবং তার কাছের মানুষেরা আলোচনার মাধ্যমে তাদের কষ্টগুলো ভাগ করে নিতে পারেন।
পরিবারের কোনো ব্যক্তি যদি অসম্পূর্ণ কাজ রেখে মৃত্যুবরণ করেন তবে বেশ কিছু সমস্যার সৃষ্টি হয়, যেমন- সম্পত্তির উত্তরাধিকার নির্ধারণ, বন্ধুর সাথে বিতর্ক ইত্যাদি। এ অবস্থায় ব্যক্তি যদি আসন্ন মৃত্যুকে অস্বীকার করেন। তবে এ বিষয়গুলো সুসম্পন্ন করতে বাধার সৃষ্টি হয়।
দ্বিতীয় ধাপ - ক্রোধ:
অস্বীকারের পরবর্তী ধাপটি হলো ক্রোধ, যেখানে আসন্ন মৃত্যুর কথা মেনে নেয়া হয়। তবে এ ক্ষেত্রে ব্যক্তির মাঝে রাগের বহিঃপ্রকাশ দেখা যায়। যেমন- 'আমিই কেন', 'এখনই কেন' ইত্যাদি। এ ধাপে ডাক্তার, নার্স এবং পরিবারের সদস্যদের সাথে শত্রুভাবাপন্ন আচরণ খুবই সাধারণ। এ ধাপে ব্যক্তি অবশ্যই কাউকে না কাউকে দোষারোপ করে থাকেন।
মৃত্যু সংবাদ কোনো ব্যক্তিকে সাধারণভাবে রাগান্বিত করে। তারা খুবই ভেঙে পড়ে এবং মনে করে অন্যরা তাকে ধোঁকা দিয়েছে। তারা সৃষ্টিকর্তা এবং তাদের পরিবার-পরিজন সবাইকে দোষী সাব্যস্ত করে। মৃত্যুশয্যায় ব্যক্তিদের পিতা-মাতা বা ঘনিষ্ঠ স্বজনেরা একই রকম অনুভূতি ব্যক্ত করে। তাছাড়াও নিজেদের ব্যর্থ ও দোষী মনে করে।
মৃত্যুর পূর্বে রাগ একটি গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা (Peterson, 1980)। দুটি উদাহরণ- একটি তরুণ ছেলের মৃত্যুর সংবাদ রাগের পাশাপাশি বিধ্বস্ত করে যাকে আমরা বলি সময়ের পূর্বে চলে যাওয়া। মৃতুশয্যায় ব্যক্তিকে ধোঁকা দেয়া হয়েছে এমন অনুভূতি খুব জোরালো থাকে। আরেকটি হলো একজন মৃত্যুশয্যাশায়ী নাস্তিক বৃদ্ধের জন্য তার মেয়ে একজন যাজককে নিয়ে আসে। কিন্তু ঐ অবস্থায় বৃদ্ধ যাজককে রাগান্বিত হয়ে বের হয়ে যেতে বলে। এতে তার মেয়ে বিব্রত হয় কিন্তু তার ভালো লাগে যে সে মৃত্যুর আগেও তার মূল্যবোধ ঠিক রেখেছে।
তৃতীয় ধাপ - শতৃমূলক আচরণ:
এ ধাপে ব্যক্তি তার কঠিন পরিণতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করে এবং মৃত্যুকে সে নিকটেই দেখতে পায়। মৃত্যু-প্রক্রিয়ার পাঁচটি ধাপের মধ্যে এ ধাপটিতে সৃষ্টিকর্তার সাথে ব্যক্তি সাধারণত চুক্তি বা সমঝোতার চেষ্টা করে। ব্যক্তি সৃষ্টিকর্তার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী হয়, পৃথিবীতে আরো কিছু সময় বেঁচে থাকার প্রত্যাশা করে যাতে সে ভালো কিছু কাজ করে যেতে পারে। এ সময়ে আনুগত্য ব্যক্তির চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
কোনো একটি নির্দিষ্ট সময় বা ঘটনা ঘটা পর্যন্ত ব্যক্তির এ আকুলতা প্রকাশ পায়। সাধারণত গুরুত্বপূর্ণ কোনো ঘটনা বা কাজ যদি সামনে থাকে (যেমন- নাতি-নাতনির জন্ম); তবে ব্যক্তি সেই সময় পর্যন্ত অবকাশ প্রত্যাশা করে থাকেন। দেখা গেছে, অনেক মৃত্যুপথযাত্রী এমন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে যাওয়া পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। উদাহরণস্বরূপ, Thomas Jefferson-এর কথা বলা যায় যিনি ১৮২৬ সালের ৪ জুলাই পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পেরেছিলেন; যা কি-না আমেরিকার স্বাধীনতা ঘোষণার পঞ্চাশ বছর পূর্তির বিশেষ দিন ছিল। গবেষণায় দেখা যায় জন্মদিনের পূর্বে মৃত্যুহার গড়ের তুলনায় নিম্ন থাকে যা জন্মদিনের পরে বেড়ে যায় (Phillips, 1972: Phillips and Feld-man, 1973)। তবে ব্যক্তি যে নিজের জন্মদিন পর্যন্ত কোনোভাবে বেঁচে থেকে যায় এ ধারণার বর্তমান বিশ্লেষণে কিছু দ্বিমতের সৃষ্টি হয়েছে (Schulz and Bazerman, 1980)। তবে ইতিবাচক ঘটনাকে সম্মুখে রেখে ব্যক্তির যে মৃত্যু-প্রক্রিয়া যে শ্লথ হয়- এটি শুধু একটি সম্ভাবনা যা আরো বেশি পর্যবেক্ষণ এবং গবেষণা প্রত্যাশা করে।
চতুর্থ ধাপ - বিষণ্ণতা:
চতুর্থ ধাপটি হলো বিষণ্ণতা, যেখানে ব্যক্তি অনুধাবন করে যে মৃত্যুকে এড়িয়ে চলার কোনো সুযোগ নেই। ধীরে ধীরে সে হতাশায় নিমজ্জিত হয়। এটি এমন একটি ধাপ যেখানে ব্যক্তির মাঝে হতাশা পরিলক্ষিত হয় এবং মৃত্যুকে অবশ্যম্ভাবী বলে মেনে নেয়া হয়।
পঞ্চম ধাপ - গ্রহণযোগ্যতা:
এটি মৃত্যু-প্রক্রিয়ার শেষ ধাপ। এ ধাপটি ব্যক্তির জন্য সুখকর নয়, আবার দুঃখজনকও নয়। Stewart Aslop নামক একজন সাংবাদিক তার আসন্ন মৃত্যুর গ্রহণযোগ্যতা প্রকাশ করেছেন এভাবে: 'যেমনি একজন নিন্দ্রালু ব্যক্তির ঘুমের প্রয়োজন; তেমনি একজন মৃত্যুপথযাত্রী ব্যক্তির মৃত্যু প্রয়োজন এবং একটি সময়ে একে বাধা প্রদান করা ভুল এবং অনর্থক' (Aslop, 1973)। গ্রহণযোগ্যতা সুখের কিংবা দুঃখের কোনো ধাপ নয়। এটি অনুভূতিশূন্য যেন ব্যথা চলে গেলে সংগ্রামও শেষ হবে (Kubler-Ross, 1969)।
উপসংহার
পরিশেষে বলা যায়, মৃত্যু-প্রক্রিয়ায় জেন্ডার এবং সম্প্রদায়ভিত্তিক বিভিন্নতাও থাকতে পারে। একজন কিশোর বা কিশোরীর মৃত্যু একজন বৃদ্ধ লোকের মৃত্যু থেকে ভিন্ন। আবার বাড়িতে মৃত্যুবরণ করা হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করা থেকে ভিন্ন। এক্ষেত্রে ব্যক্তিত্বও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমরা যে ধরনের ব্যক্তিত্ব ধারণ করি তার উপর নির্ভর করে মৃত্যুর প্রতি আমাদের অভিগমন। চিন্তাশীল অথবা আবেগপ্রবণ, উষ্ণ কিংবা উদাসীন ব্যক্তিত্ব কিছুটা হলেও নির্ধারণ করে দেয় মৃত্যুর প্রতি আমরা কীভাবে প্রতিক্রিয়া করব। মৃত্যু-প্রক্রিয়া যা ব্যক্তিত্বের বিষয়টিকে বহির্গত করে তা বাস্তবতার অনেকাংশকেই বহির্গত করে (Kasten baum, 1975)।