সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণ
সিজোফ্রেনিয়া গোলাযোগ আক্রান্ত ব্যক্তির সব রকম মনোদৈহিক কার্যকলাপের অবনতি ঘটে। ব্যক্তির চিন্তন, আবেগ ও আচরণ লক্ষণীয়ভাবে ত্রুটিপূর্ণ হয়ে পড়ে। অল্প বয়সে এরূপ গোলাযোগের উৎপত্তি হয় বলে আগে এ রোগটিকে 'অপরিণত বয়সের চিত্তবিনাশ' নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। পরে দেখা গিয়েছে যে এ ধরনের গোলযোগ যে কোনো বয়সেই ঘটতে পারে। তবে সাধারণত যৌবনের প্রারম্ভ কালেই এ রোগের উৎপত্তি বেশি হয়। সিজোফ্রেনিয়াকে অনেকে ভুল করে বহুমুখী ব্যক্তিত্বের (Multiple Personality) সাথে একত্র করেন। সিজোফ্রেনিয়াগ্রস্ত রোগীর একটি মাত্র ব্যক্তিত্ব থাকে। কিন্তু এ রোগীর মানসিক অবস্থা প্রায়শই দারুণভাবে বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে।
সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণ:
সিজোফ্রেনিক রোগীদের মধ্যে বিশেষ লক্ষণ হলো বাস্তবের সাথে সংযোগ রক্ষা করতে না পারা।
DMS-IV অনুযাযী সিজোফ্রেনিয়াগ্রস্ত রোগীর ক্ষেত্রে তিনটি প্রধান লক্ষণ দেখা যায়; যেমন, চিন্তার অস্বভাবিতা, ভ্রান্ত বিশ্বাস এবং অলীক প্রত্যক্ষণ। কিন্তু এসব লক্ষণ ছাড়াও সিজোফ্রেনিক রোগীদের মধ্যে আরো অনেক লক্ষণ দেখা যায়; যেমন, বিক্ষুব্ধ আবেগ, উভয়মুখী আচরণ, আত্মকেন্দ্রিকতা, বাস্তব থেকে অপসারণ, বিচারক্ষমতার হ্রাস এবং উৎসাহীনতা।
১. চিন্তার অস্বভাবিতা (Thought Disorder):
অধিকাংশ সিজোফ্রেনিক রোগীর মধ্যে চিন্তা, আবেগ ও প্রত্যক্ষণের অস্বভাবিতা দেখা যায়। সিজোফ্রেনিক রোগীদের চিন্তায় কোনো যুক্তিকতা নেই। মিহল (Meehl, ১৯৬২) বলেন- সিজোফ্রেনিক রোগীদের চিন্তায় জ্ঞানীয় বিচ্যুতি লক্ষ করা যায়। এ রোগীর চিন্তাধারা মাঝে মাঝে লাইনচ্যুত হয়ে যায়। তাছাড়া রোগী অপ্রাসঙ্গিক বিষয় সম্বন্ধে চিন্তা করে থাকে। চিন্তার অস্বভাবিতার কারণ হলো বাস্তবতাকে স্বীকার করার তাগিদ। সিজোফ্রেনিক রোগীরা যখন কোনো চিঠিপত্র লেখে; সেই পত্রের বক্তব্যটি অসম্পূর্ণ অংশ-বিশেষ বলে মনে হবে। এসব রোগীকে কোনো কিছু জিজ্ঞাসা করা হলে তারা অদ্ভুত ধরনের উত্তর দিয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, রোগীকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয় তোমার নাম কী? তাহলে সে হয়ত উত্তর দেবে, আমার পিতা ঢাকায় থাকেন।
২. ভ্রান্ত বিশ্বাস (Delusions):
সিজোফ্রেনিক রোগী ব্যতীত অন্যান্য মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত ব্যক্তির মধ্যেও ভ্রান্ত বিশ্বাস দেখা যায়। তবে সিজোফ্রেনিক রোগীদের ভ্রান্ত বিশ্বাস উদ্ভট প্রকৃতির হয়ে থাকে। অনেক রোগী মনে করে থাকে যে, কোনো রহস্যময় শক্তি তাদের চিন্তা-ধারাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। কেউ কেউ মনে করে তাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র চলছে আবার কেউ মনে করে তাকে যন্ত্রপাতি দ্বারা আঘাত করা হচ্ছে। অনেক সময় রোগীর মধ্যে নির্বাচিত হওয়ার ভ্রান্ত বিশ্বাসও দেখা দিতে পারে।
৩. অলীক প্রত্যক্ষণ (Hallucinations):
অলীক প্রত্যক্ষণ হলো কোনো উদ্দীপকের বাস্তব উপস্থিতি ব্যতীত কোনো বস্তুকে প্রত্যক্ষণ করা। অলীক প্রত্যক্ষণ পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে সংঘটিত হতে পারে; যেমন, রোগী কোনো একটি কণ্ঠস্বর সম্পর্কে শ্রবণমূলক অলীক প্রত্যক্ষণের অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারে, দৃশ্যমান বস্তু বা মানুষ সম্পর্কে দর্শনমূলক অলীক প্রত্যক্ষণ হতে পারে। এসব অলীক প্রত্যক্ষণের মধ্যে শ্রবণমূলক অলীক প্রত্যক্ষণ সিজোফ্রেনিক রোগীদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। রোগীর মনে হতে পারে যে সে অন্য কোনো ব্যক্তির সাথে আলাপ করছে এবং কারো সম্পর্কে মন্তব্য শুনতে পাচ্ছে। অনেক সময় রোগী এসব কন্ঠস্বরের প্রতি প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতেও পারে।
৪. বিক্ষুব্ধ আগে (Affective Disturbances):
সিজোফ্রেনিক রোগী তার চারপাশের ঘটনাবলি সম্পর্কে উদাসীন থাকে, আবেগ প্রকাশের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে এবং গতিহীন হয়ে পড়ে। রোগীর চিন্তা-ভাবনায় কোনো বৈচিত্র্য থাকে না। সিজোফ্রেনিক রোগীদের আবেগ সামাজিক রীতি-নীতির পরিপন্থি। রোগী অযথাযথভাবে আবেগ প্রকাশ করতে পারে; যেমন, রোগীকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয় তার উপর কোনো অদৃশ্য শক্তি নির্যাতন চালায়? এ প্রশ্নের উত্তরে রোগী মৃদুভাবে হাসতে পারে বা উচ্চস্বরে হাসতে পারে।
৫. উভয়মুখী আচরণ (Ambivalence):
সিজোফ্রেনিক রোগী কখনও হাসে আবার কখনও কাঁদে লোকজনের সামনে কাপড়-চোপড় খুলে উলঙ্গ হয়ে পড়ে এবং একই সময়ে এরূপ কর্মের জন্য নিজেকে দায়ী করে। এসব রোগী যাকে আদর-স্নেহ করে তাকে অবিশ্বাসও করতে পারে। তাদের কাজ ও কর্মে পরস্পর-বিরোধী প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায়।
৬. আত্মকেন্দ্রিকতা:
এ রোগীরা নিজস্ব চিন্তাধারার মধ্যে মগ্ন থাকে। বাস্তব অবস্থা থেকে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে আলাদা করে রোগী তার চারপাশে এক দেওয়াল খাড়া করে।
৭. বাস্তব থেকে অপসারণ:
সিজোফ্রেনিক রোগী ধীরে ধীরে নিজেকে বাস্তব অবস্থা থেকে সরিয়ে নেয়। এ পৃথিবীর কোনো কিছুই তাদের ভালো লাগে না। এমন কি খাদ্যগ্রহণ, নিদ্রা, যৌনচাহিদা ইত্যাদি জৈবি কার্যাবলির প্রতিও কোনো প্রতিক্রিয়া করে না।
৮. বিচারক্ষমতা হ্রাস:
এসব রোগীর বিচারক্ষমতা হ্রাস পায়। কোনো একটি বিষয় ভালো কি মন্দ এ ব্যাপারে রোগী কিছুই বলতে পারে না। বিচার-বিশ্লেষণ ক্ষমতা হারিয়ে এসব রোগী একটি বিচ্ছিন্ন জীবন অতিবাহিত করে।
৯. উৎসাহহীনতা:
সিজোফ্রেনিক রোগীরা কাজ-কর্মে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। বেঁচে থাকার আনন্দ তাদের থাকে না।
উপসংহার:
সিজোফ্রেনিয়া একটি জটিল প্রকৃতির মানসিক ব্যাধি। এ ব্যাধির চিকিৎসার জন্য রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করা ছাড়া উপায় থাকে না। সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত রোগীরা খুব উগ্র, উত্তেজিত এবং আক্রমণাত্মক আচরণ করতে পারে। এসব রোগীর চিন্তার ক্ষেত্রে অস্বভাবিতা দেখা যায়, তাদের মধ্যে ভ্রান্ত বিশ্বাস ও অলীক প্রত্যক্ষণ বেশি কাজ করে।