কেস স্টাডি পদ্ধতি
অস্বাভাবিক মনোবিজ্ঞানের লক্ষ্য হলো অনুপযোগী আচরণের কার্যকরন অনুসন্ধান করা, বিশ্লেষণ করা, ব্যাখ্যা করা, চিকিৎসা সেবা উন্নয়ন এবং প্রতিরোধ কার্যক্রম নির্ধারণ। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য অস্বভাবী মনোবিজ্ঞান বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে অস্বভাবী আচরণের উপর পরীক্ষণ ও গবেষণা সম্পন্ন করেন। অস্বভাবী আচরণ অনুধ্যানে যেসব পদ্ধতি ব্যবহৃত হয় সেগুলোর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি পদ্ধতি হলো জীবন অনুধ্যান বা কেস স্টাডি পদ্ধতি।
জীবন অনুধ্যান বা কেস স্টাডি পদ্ধতি:
মনোবিজ্ঞানের সবচেয়ে পরিচিত এবং প্রাচীন পদ্ধতি হলো কেস স্টাডি পদ্ধতি বা চিকিৎসা-পদ্ধতি। পদ্ধতিটি হলো একজন ব্যক্তিকে এক সময়ে বিশেষভাবে অনুধ্যান করা (study) এবং তার সম্বন্ধে বিস্তৃত তথ্য লিপিবদ্ধ করা। একজন মনোচিকিৎসক বা ক্লিনিশিয়ানের নিকট যখন একজন মানসিক রোগী বা সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তি পরামর্শ চাইতে আসেন, তখন তাকে বলা হয় 'কেস' (case)। চিকিৎসক তখন সেই ব্যক্তির জীবনের ঘটনাবলিসহ তার জীবনবৃত্তান্ত, সমস্যার প্রকৃতি, সমস্যাটি কত দিন যাবৎ শুরু হয়েছে, তিনি কী কী চিকিৎসা-ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন ইত্যাদি তথ্য লিপিবদ্ধ করেন। এটাই কেস স্টাডি বা চিকিৎসামূলক পদ্ধতি। একটি পূর্ণাঙ্গ কেস স্টাডি করতে হলে সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তি সম্পর্কে নিম্নলিখিত তথ্য সংগ্রহ করতে হবে:
১. পারিবারিক ইতিহাস, (Family history), পরিবারের কেউ মানসিক ভাবে সুস্থ হয়েছিলেন কিনা?
২. শিক্ষাগত পটভূমি (Educaional background), অর্থাৎ ব্যক্তির স্কুলজীবনের ইতিহাস, সাফল্য ও ব্যর্থতার বিবরণ।
৩. চাকরি এবং পেশা বা বৃত্তি-সম্পর্কিত তথ্য।
৪. বিবাহিত জীবনের ইতিবৃত্ত (marital history)
৫. বিকাশ-সম্পর্কিত তথ্য।
৬. স্কুল, পরিবার এবং চাকরিস্থলে ব্যক্তিগত উপযোজনের ধরন।
৭. ব্যক্তিত্ব
৮. বর্তমান পরিস্থিতি
৯. ব্যক্তির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, ক্ষমতা ও অক্ষমতা।
এখানে বিশেষভাবে মনে রাখা প্রয়োজন যে, চিকিৎসক কী কী তথ্য সংগ্রহ করবেন এবং কোন কোন তথ্যের উপর বেশি গুরুত্ব দেবেন তা নির্ভর করে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি বা চিকিৎসামূলক প্যারাডাইমের (Paradigm) উপর। শুধু একটি মাত্র দৃষ্টান্ত দেওয়া যায় যে, একজন মনোসমীক্ষক (Psychoanalyst) যখন একজন ব্যক্তির ব্যক্তি ইতিহাস সংগ্রহ করেন তখন তিনি শৈশবের ঘটনাবলির এবং তার পিতামাতার সঙ্গে তার দ্বন্দ্বগুলোর উপর যত বেশি গুরুত্ব দেন একজন আচরণবাদী মনোচিকিৎসক সেগুলোর উপর তত বেশি গুরুত্ব দেন না।
কেস স্টাডি পদ্ধতির আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, এই পদ্ধতিতে যেসব তথ্য পাওয়া যায় সেগুলো অনেক সময় নির্ভরযোগ্য না-ও হতে পারে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ব্যক্তির বর্ণনাত্বক ইতিহাস সংগ্রহ করে অস্বাভাবিক আচরণ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। একই ধরনের সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তিদের নিকট থেকে ইতিহাস সংগ্রহ করা হলো সমস্যার কার্যকরণ-সম্পর্কে অনুমান তৈরি করা যায়। ফ্রয়েডের মনোসমীক্ষণ-তত্ত্বের একমাত্র ভিত্তি হলো ইতিহাস বা কেস স্টাডি পদ্ধতি। ডেভিসন ও ল্যাজারস (davison and Lazars, 1994) কেস স্টাডির ব্যবহার সম্পর্কে বলেছেন, কেস স্টাডি নিম্নলিখিত উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়ে আসছে:
১. কোনো একটি ব্যতিক্রমধর্মী, বিরল ঘটনার বিস্তৃত বর্ণনা প্রদান, সাক্ষাৎকার গ্রহণ, রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসার অভিনব ও গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতির বিস্তৃত বিবরণ প্রদান।
২. কোনো একটি বিশেষ তাত্ত্বিক প্রতিপাদ্যের তথাকথিত সার্বজনীন বৈশিষ্ট্য/দিকগুলোর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রদান।
৩. অনুমাণ/প্রকল্প তৈরি করা যাতে করে পরবর্তীকালে নিয়ন্ত্রণ পরীক্ষণের মাধ্যমে এগুলো সত্যতা যাচাই করা যায়।
কেস স্টাডি পদ্ধতির সবচেয়ে ভালো দিক হলো এই যে, অন্য যে কোনো পদ্ধতির চেয়ে এ পদ্ধতিতে একজন ব্যক্তি সম্পর্কে বেশি তথ্য সংগ্রহ করা যায় এবং এসব তথ্যে অন্তর্দৃষ্টিমূলক উপাদান বেশি থাকে।
উপসংহার:
আলোচনার পরিশেষে বলা যায় যে, বিভিন্ন উৎস থেকে এক বা একাধিক ব্যক্তি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে সেগুলো বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ব্যক্তি সম্পর্কে ধারণা লাভ করার কৌশলকে কেস স্টাডি/ঘটনা বিবরণপদ্ধতি বলে। এ পদ্ধতিতে ব্যক্তিকে বিভিন্ন অসংগঠিত প্রশ্ন করে তার ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক ও সামাজিক জীবন সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়।