মনোবিজ্ঞানের গবেষণায় নৈতিক আদর্শ

মনোবিজ্ঞানের গবেষণায় নৈতিক আদর্শ (Research Ethics in Psychology) 

মনোবিজ্ঞান মানুষ ও প্রাণীর আচরণ নিয়ে গবেষণা করে। মানুষ ও প্রাণী উভয়ই জীব। তাই গবেষণা করতে গিয়ে মানুষ ও প্রাণীর যাতে কোন ক্ষতি না ঘটে সেদিকে বিশেষ লক্ষ রাখার জন্য আমেরিকান মনোবিজ্ঞান সমিতি (American Psychological Association- APA) ১৯৭৩ সালে নৈতিক আদর্শের কতিপয় নীতিমালা তৈরি করে। এই নীতিমালা তৈরির পশ্চাতে একটি ইতিহাস আছে।

সর্বপ্রথম ১৯৩২ সালে USA-এর Public Health Service ৩৯৯ জন দরিদ্র অর্ধ- শিক্ষিত কৃষ্ণাঙ্গ সিফিলিস রোগীর ওপর একটি পরীক্ষণ পরিচালনা করে। এটা Tuskegee Study নামে পরিচিত। এই পরীক্ষণের মূল উদ্দেশ্য ছিল সিফিলিস রোগীদের চিকিৎসা না করা হলে তাদের মধ্যে কি লক্ষণ প্রকাশ পায় তা পর্যবেক্ষণ করা। গবেষণার মূল উদ্দেশ্য গোপন রেখে রোগীদের চিকিৎসা করা হবে বলে তাদেরকে ১৫ দিন পর পর চিকিৎসা কেন্দ্রে আসতে বলা হয়। এতে রোগীরা রাজি হয় এবং ১৫ দিন পর পর তারা চিকিৎসা কেন্দ্রে আসলেও প্রকৃতপক্ষে তাদের কোন চিকিৎসা করা হয়নি। এতে যারা মারা যায়, পরবর্তীতে তাদের লাশ কেটে সিফিলিস রোগের কারণ ও লক্ষণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হয়।

৪০ বছর পর ১৯৭২ সালে আমেরিকার জনগণ এ তথ্য জানতে পারে এবং তারা এই গবেষণাকে অনৈতিক বলে দাবি করে। কারণ ইতিমধ্যে ১৯৪০ সালে সিফিলিস রোগের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ওষুধ পেনিসিলিন আবিষ্কৃত হলেও রোগীদের তা দেয়া হয়নি। এমনকি ১৯৭২ সালেও যারা বেঁচে ছিল তাদেরকেও পেনিসিলিন দেয়া হয়নি। এজন্য এই গবেষণাটি ছিল সম্পূর্ণ অনৈতিক এবং এর নাম দেয়া হয় Unethical Ethics। ফলে গবেষণায় নৈতিকতা অনুমানের জন্য APA ১৯৮১ সালে মনোবৈজ্ঞানিক গবেষণায় নৈতিক আদর্শের guide line পুনঃপ্রকাশ করে তা বাস্তবায়নের ব্যবস্থা নেয়। মানুষ ও প্রাণীর ওপর গবেষণার নীতিমালাগুলি পৃথকভাবে প্রকাশ করা হয়। মানুষের ক্ষেত্রে নীতিমালাগুলি নিম্নরূপ : কোন গবেষণার পূর্বে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি বিশেষ লক্ষ রাখতে হবে।

(ক) প্রথমত, যে গবেষণাটি করা হবে তা মানবকল্যাণে কাজে লাগবে কি-না তা বিচার করতে হবে।

(খ) দ্বিতীয়ত, মানবকল্যাণ সাধিত হবে এই উদ্দেশ্য নিয়ে যাদেরকে গবেষণায় পরীক্ষণপাত্র হিসেবে ব্যবহার করা হবে তাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকেই গবেষণাটি পরিচালনা করতে হবে। আর গবেষণা পরিচালনা করার পূর্বে নিম্নলিখিত নৈতিক আদর্শের নীতিগুলি মেনে চলার অঙ্গীকার করতে হবে।

১. নীতিগত সমর্থন (Ethical support ) : যে গবেষণাটি পরিচালনা করা হবে তাতে অন্যান্য গবেষকদের সমর্থন আছে কি-না তা যাচাই করতে হবে। অন্য গবেষকদের সমর্থন না থাকলে গবেষণা করা ঠিক হবে না। তাছাড়া গবেষণাটি অনৈতিক হলে পরিত্যাজ্য হবে আর নৈতিক হলে তা গৃহীত হবে।

২. দায়িত্ব (Responsibility) : একটি গবেষণা পরিচালনার ক্ষেত্রে একজন মূল গবেষক এবং একাধিক গবেষণা সহকারী থাকেন। সকলকেই গবেষণার নৈতিক আদর্শ মেনে চলতে হয়। তথাপিও সকল ক্ষেত্রে নৈতিক আদর্শের যথারীতি অনুসৃত হচ্ছে কি-না তা দেখার জন্য প্রধান গবেষকের দায়িত্ব সর্বাধিক।

৩. পরীক্ষকের আনুষ্ঠানিক সম্মতি (Formal Consents of the Subjects) : গবেষণায় যারা পারীক্ষ হিসেবে অংশগ্রহণ করবেন গবেষণায় সম্মতি স্বরূপ তাঁরা একটি চুক্তিপত্র (contract form) স্বাক্ষর করবেন। এরপর গবেষক গবেষণার উদ্দেশ্য এবং তাদের করণীয় সম্পর্কে সবকিছু বুঝিয়ে বলবেন।

৪. আংশিক প্রতারণা (Deception) : অনেক সময় গবেষণার মূল উদ্দেশ্য এবং অন্যান্য সব বিষয় পরীক্ষকদের জানালে গবেষণা বিফলে যাবার সম্ভাবনা থাকে। সেক্ষেত্রে গবেষক কিছুটা ছল-চাতুরীর আশ্রয় নিতে পারেন। তবে কেন এই চাতুর্যের আশ্রয় নেয়া হল গবেষণা শেষ হবার পর তিনি পারীক্ষদের তা বুঝিয়ে বলবেন।

৫. গবেষণা-পরবর্তী তথ্য জানানো (Debriefing) : গবেষণা শেষে, কেন কিছুটা ছল- চাতুরীর আশ্রয় নেয়া হয়েছিল সে সম্পর্কে বুঝিয়ে বলার পর প্রাপ্ত তথ্য সম্পর্কে গবেষক কি তথ্য পেলেন, কিংবা কি ধারণা পোষণ করলেন বা কি সিদ্ধান্ত নিবেন সে সম্পর্কেও অংশগ্রহণকারীদের তথ্য জানাবেন।

৬. বাধ্যবাধকতা বা জোরজবরদস্তি থেকে মুক্ত (Freedom of Coercion) : গবেষণায় অংশগ্রহণকারী পরীক্ষণ পাত্রদের যথেষ্ট স্বাধীনতা থাকতে হবে। নিজ সম্মতিতে অংশগ্রহণ করলে যদি তার ভালো না লাগে তাহলে গবেষণা ছেড়ে চলে যাবার তার পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে। সুতরাং সর্বাবস্থায় অথবা গবেষণা সহকারী তাদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখবেন।

৭. গোপনীয়তা (confidentiality) : গবেষণায় অংশগ্রহণকারী কোন পরীক্ষণ পাত্র তার তথ্য প্রকাশ করতে না চায় তাহলে তা গোপন রাখতে হবে। অবশ্য তাঁর অনুমতি নিয়ে গবেষক তা প্রকাশ করতে পারেন।

৮. সতর্কমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ (Carefulness) : গবেষণায় সব ধরনের সতর্কমূলক ব্যবস্থা গবেষককে নিতে হবে। পরীক্ষণ পাত্রের কোন প্রকার বিপদের ঝুঁকির সম্ভাবনা থাকলে সে সম্পর্কে গবেষক আগেই সাবধানতা অবলম্বন করবেন।

প্রাণী গবেষণায় নৈতিকতা (Ethics for Animal Research) 

নৈতিকতা একটি অনুভূতিশীল ব্যাপার। তাই এটা নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে APA নিম্নলিখিত নীতিমালা প্রণয়ন করে এবং সকল গবেষককে তা মেনে চলার আহ্বান জানায়।

১. প্রাণীদের সাথে সদয় সহানুভূতিশীল আচরণ করতে হবে। প্রাণী বলে তাকে কোনরূপ অবহেলা করা যাবে না।

২. গবেষণার পূর্বে যেখানে প্রাণী নিয়ে গবেষণা করতে হবে সে পরিবেশটা পরিষ্কার- পরিচ্ছন্ন এবং স্বাস্থ্যকর রাখতে হবে।

৩. তাদের আরাম-আয়েসের সকল বিষয়ের প্রতি মনোযোগী হতে হবে। তাদের থাকা-খাওয়ার সকল প্রকার সুব্যবস্থা রাখতে হবে এবং তাদের যাতে কোন প্রকার অসুবিধার সৃষ্টি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

৪. কোন জটিল গবেষণায় অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হলে তাদেরকে ওষুধ প্রয়োগে ভালোভাবে অজ্ঞান করে নিতে হবে এবং যতক্ষণ সম্পূর্ণ অজ্ঞান না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

৫. যদি প্রাণী মারা যাবার সম্ভাবনা থাকে তাহলে মারা না যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে এবং পরিবেশ দূষিত না হয় এমনভাবে তাকে মাটিতে দাফন করতে হবে।

৬. আর যদি মারা না যায় তাহলে তাকে সুচিকিৎসার সবরকম ব্যবস্থা করতে হবে এবং গবেষণা শেষে সম্পূর্ণ সুস্থ হলে তাকে স্বজাতির কাছে বা স্ব পরিবেশ ছেড়ে দিতে হবে।

৭. সর্বোপরি প্রাণী নিয়ে গবেষণায় পশুপালন অধিদপ্তর থেকে প্রাণী রক্ষার বিভিন্ন আইন-কানুন সম্পর্কে অবহিত হতে হবে।

যে কোন গবেষণার উদ্দেশ্য হচ্ছে সমাজের কল্যাণ সাধন করা। তাই মনোবিজ্ঞানীদের লক্ষ্য হওয়া উচিত নৈতিকতার সকল আদর্শ মেনে চলে সমাজের কল্যাণ সাধন করা।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url