চিকিৎসা মনোবিজ্ঞান
চিকিৎসা মনোবিজ্ঞান (Clinical Psychology)
চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানীরা সাধারণত মানসিক রোগের কারণ, প্রকৃতি ও লক্ষণ নির্ণয় করে তার চিকিৎসা করেন। বর্তমানে সঠিক তথ্য জানা না গেলেও ১৯৬০ দশকের শেষের দিকে আমেরিকাতেই সর্বোচ্চ ৩৬% থেকে ৩৮% মনোবিজ্ঞানী এই পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। বর্তমানে আমাদের দেশেও বেশ কয়েকজন খ্যাতিমান মনোবিজ্ঞানী এই পেশায় নিয়োজিত আছেন।
চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানীরা সাধারণত তিনটি বিশেষ গোষ্ঠীভুক্ত। যথা মনোচিকিৎসাবিদ (Psychiatrist), মনোবিশ্লেষক (Phychoanalyst) এবং চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী (Clinical Psychologist)। মনোচিকিৎসাবিদদের সকলেরই চিকিৎসাশাস্ত্রে ডিগ্রি আছে। খুব কম সংখ্যক মনোসমীক্ষক আছেন যাদের চিকিৎসাশাস্ত্রে কোন ডিগ্রি নেই। তবে চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানীদের সাধারণত চিকিৎসাশাস্ত্রের কোন ডিগ্রি থাকে না। মনোচিকিৎসাবিদ এবং মনোসমীক্ষক উভয়েই চিকিৎসাশাস্ত্রের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। চিকিৎসাশাস্ত্রে কোন ডিগ্রি প্রাপ্তির পর তাঁরা অস্বভাবী আচরণের কারণ ও প্রকৃতি নির্ণয় এবং তার চিকিৎসা সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ হিসেবে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। সাধারণত কোন সাইকিয়াট্রিক ওয়ার্ড বা হাসপাতালে এই প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। প্রশিক্ষণের সময় মনোবিজ্ঞানের ওপর কাজ করার জন্য তেমন কোন ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয় না। মনোসমীক্ষকও একজন মনোচিকিৎসাবিদ। তবে প্রকৃত মনোচিকিৎসাবিদের সাথে তাঁর পার্থক্য এই যে অস্বভাবী আচরণের কারণ ও প্রকৃতি নির্ণয় এবং তার চিকিৎসার জন্য মনোসমীক্ষক সাধারণত ফ্রয়েড ও তাঁর অনুসারীদের দেয়া মনঃসমীক্ষণ পদ্ধতি অনুসরণ করেন।
অন্যপক্ষে চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানীরা চিকিৎসাশাস্ত্রের পরিবর্তে মনোবিজ্ঞানের ওপরেই প্রাথমিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। মনোবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে দুই-তিন বছর ধরে প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর অস্বভাবী আচরণের মনস্তাত্ত্বিক কারণ ও প্রকৃতি নির্ণয় এবং তার চিকিৎসার জন্য গবেষণা পরিচালনার মাধ্যমে বিশেষজ্ঞ হিসেবে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। রোগের প্রকৃতি নির্ণয়ের ক্ষেত্রে মনোবিজ্ঞানের বিভিন্ন অভীক্ষার প্রয়োগ, সাফল্যাংক নির্ণয় এবং কিভাবে তার ব্যাখ্যা প্রদান করতে হয় সে সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। মানসিক রোগ চিকিৎসায় মনোচিকিৎসা পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে কিভাবে ব্যক্তির আবেগজনিত সমস্যা দূর করা যায় তার জন্য তাঁরা মনোসমীক্ষণ এবং অন্যান্য সাক্ষাৎকার পদ্ধতির ওপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। মনোচিকিৎসা পদ্ধতিতে কোনরূপ বৈদ্যুতিক আঘাত বা ওষুধ প্রয়োগ ছাড়া শুধুমাত্র মনস্তাত্ত্বিক পন্থায় সরল ও জটিল মানসিক রোগ কিংবা সংগতিবিধানের সমস্যার চিকিৎসা করা হয়।
বহুদিন ধরে শুধুমাত্র মানসিক চিকিৎসাবিদরা মানসিক রোগের শ্রেণী বিভাগ এবং তার চিকিৎসা করে আসছিলেন। কিন্তু যখন তাঁরা বুঝতে পারলেন যে মনোবিজ্ঞানীদের আবিষ্কৃত বুদ্ধি ও ব্যক্তিত্বের অভীক্ষাগুলি প্রয়োগের মাধ্যমে সাইকিয়াট্রিক সেবা-যত্ন বা চিকিৎসায় বিশেষ সুফল পাওয়া যাচ্ছে তখনই তাঁরা মনোবিজ্ঞানীদের সাহায্য নিতে শুরু করেন। বর্তমানে ব্যক্তিত্ব নির্ণয়ে তাঁরা নিয়মিত মনোবৈজ্ঞানিক অভীক্ষা প্রয়োগ করে থাকেন। এতে মানসিক রোগ নির্ণয় ও তার চিকিৎসা ক্ষেত্রে তাঁরা প্রভূত সুফল পেয়ে আসছেন।
সাম্প্রতিককালে অধিকাংশ চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী মানসিক রোগ চিকিৎসা পদ্ধতির ওপর প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকেন। অনেক হাসপাতালে তাঁদের চাহিদাও আছে। কেননা এসব হাসপাতালে তাঁরা ব্যাপকভাবে মানসিক চিকিৎসা পদ্ধতি প্রয়োগ করেন। আরও উল্লেখ্য যে, আমেরিকার বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে যেসব চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী নিয়োজিত আছেন তাঁদের অধিকাংশ নিজ দায়িত্বে মনোচিকিৎসা পদ্ধতি প্রয়োগ করেন। তবে এসব ক্ষেত্রে রোগীর কোন শারীরিক চিকিৎসার প্রয়োজন আছে কি-না তা তাঁরা আগেই পরীক্ষা করে নেন।
মানসিক রোগ নির্ণয় ও তাঁর চিকিৎসা ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি সাধিত হলেও এক্ষেত্রে এখনও যথেষ্ট গবেষণার প্রয়োজন আছে। মনোচিকিৎসাবিদরা শুধুমাত্র চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত থাকার কারণে এ ব্যাপারে গবেষণা পরিচালনার দায়িত্ব মনোবিজ্ঞানীদের পালন করতে হচ্ছে। সুতরাং সংশ্লিষ্ট সকলেই এ বিষয়ে একমত যে মানসিক রোগ নির্ণয় ও তার চিকিৎসাক্ষেত্রে চিকিৎসাবিদ, মনোবিজ্ঞানী এবং সমাজকর্মী এই তিন শ্রেণীর লোক নিয়ে গঠিত একটি দল একযোগে কাজ করে যেতে পারেন। রোগীর চিকিৎসার দায়িত্ব চিকিৎসকদের ওপর ন্যস্ত থাকবে; মনোবিজ্ঞানী গবেষণার নেতৃত্ব দেবেন এবং রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা পদ্ধতি প্রয়োগে সহায়তা করবেন। আর সমাজকর্মী রোগী সম্পর্কে অতীত ও বর্তমানের ব্যক্তিগত এবং বস্তুনিষ্ঠ তথ্য সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত থাকবেন।