ক্ষেত্রপর্যবেক্ষণ পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য
সমাজ মনোবিজ্ঞান গবেষণার জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি হচ্ছে পর্যবেক্ষণ-পদ্ধতি। আচরণ সম্বন্ধীয় পর্যলোচনার সবচেয়ে প্রাচীন পদ্ধতি হলো পর্যবেক্ষণ। সমাজ মনোবিজ্ঞানে পর্যবেক্ষণ-পদ্ধতি বলতে মূলত ক্ষেত্রপর্যবেক্ষণকেই বোঝানো হয়।
ক্ষেত্রপর্যবেক্ষণ পদ্ধতি
ক্ষেত্র বলতে প্রাকৃতিক পরিস্থিতি বোঝায়। প্রাকৃতিক পরিস্থিতিতে ব্যক্তির আচরণ সুশৃঙ্খলভাবে পর্যবেক্ষণ করাকে ক্ষেত্রপর্যবেক্ষণ বলা হয়। উদাহরণস্বরূপ বিভিন্ন সামাজিক পরিস্থিতিতে শিশুর আচরণ সংক্রান্ত একটি গবেষণার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে (বার্কার ও রাইট, ১৯৫৪)। এই গবেষণায় বিদ্যালয়ে, খেলার মাঠে, গানের ক্লাশে ইত্যাদি বিভিন্ন পরিস্থিতিতে গবেষকগণ শিশুদের আচরণ পর্যবেক্ষণ করেন এবং তা থেকে পরিস্থিতি অনুসারে শিশুদের আচরণের ধরন কেমন হয় সে সম্বন্ধে আমরা জানতে পারি। পূর্বসংস্কার, পারস্পরিক আকর্ষণ ইত্যাদি অনেক ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করে অনেক বৈজ্ঞানিক তথ্য সংগ্রহ করা যেতে পারে।
ক্ষেত্রপর্যবেক্ষণ পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য
ক্ষেত্রপর্যবেক্ষণে যেহেতু ব্যক্তি কোনো কৃত্রিম পরিস্থিতিতে থাকে না সে কারণে তার আচরণ স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত থাকে। এই স্বাভাবিকতা ও স্বতঃস্ফূর্ততাই ক্ষেত্র-পর্যবেক্ষণের প্রধান সুবিধা।
সাধারণত কোনো জটিল বিষয়ে গবেষণার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করে গবেষক যথার্থ উপকৃত হতে পারেন।
অনেক আচরণ রয়েছে যা স্বাভাবিক পরিস্থিতি ছাড়া কোনোভাবেই পর্যালোচনা করা সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে প্রকৃত পরিস্থিতিতে সুশৃঙ্খলভাবে পর্যবেক্ষণ করাই একমাত্র পদ্ধতি হিসেবে বিবেচিত হবে। উদাহরণস্বরূপ উচ্ছৃঙ্খল জনতার আচরণ সম্পর্কে গবেষণার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক পরিস্থিতিতে পর্যবেক্ষণই তথ্য সংগ্রহের একমাত্র নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি।
তবে এ পদ্ধতি সুষ্ঠুভাবে প্রয়োগ করতে হলে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন যে, যাকে বা যাদেরকে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে তাদের কাছে যেন গবেষণার উদ্দেশ্য ধরা না-পড়ে। তাই গবেষককে অন্তরালে থেকে তথ্য সংগ্রহ করা প্রয়োজন।
কারণ তাঁর উপস্থিতি অনেক ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলে গবেষণার উদ্দেশ্যকে ব্যর্থ করে দিতে পারে।
পর্যবেক্ষণ-পদ্ধতির সুবিধাসমূহ:
নিম্নে পর্যবেক্ষণ-পদ্ধতির সুবিধাসমূহ প্রদত্ত হলো-
- প্রকৃত তথ্য সংগ্রহ করা যায়: এ পদ্ধতিতে গবেষক সরাসরি ঘটনা বা বিষয়বস্তুর অঞ্চলে প্রবেশ করেন। অতঃপর বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য গবেষক সরাসরি পঞ্চেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ করে প্রাথমিক বা প্রকৃত তথ্য সংগ্রহ করেন।
- বিস্তৃত তথ্য সংগ্রহ: পর্যবেক্ষণ-পদ্ধতিতে পরিচালিত তথ্যানুসন্ধানে ঘটনা বা বিষয়বস্তুর সম্পর্কে খুঁটিনাটি সকল বিষয় গবেষকের দৃষ্টিতে পড়ে। ফলে এর মাধ্যমে বিষয়বস্তু সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য লাভ করা যায়।
- প্রকৃত আচরণ অনুধ্যান: মানুষকে দেখে তার প্রকৃত আচরণ সম্পর্কে অবগত হওয়ার একমাত্র পদ্ধতি হচ্ছে পর্যবেক্ষণ-পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে যেহেতু পর্যবেক্ষক পর্যবেক্ষণীয় দলের একজন সদস্য হিসেবে পরিগণিত হন তাই তিনি দলীয় সদস্যদের রীতিনীতি, সংস্কৃতি, প্রাচীন ঐতিহ্য, আচরণের প্রকৃতি সম্পর্কে তাৎপর্যপূর্ণ গবেষণা করতে পারেন।
- সত্য তথ্য সংগ্রহ: পর্যবেক্ষণ তুলনামূলকভাবে স্বাধীন ও মুক্ত। গবেষকের ইচ্ছা ও যোগ্যতার ওপর এর সার্থকতা নির্ভর করে। এজন্য এর মাধ্যমে প্রকৃত সত্য তথ্য সংগ্রহ করা সহজ হয়। গবেষক যেহেতু দলের সদস্য হয়ে যান তাই তিনি তাদের বিশ্বাস, মনোভাব, আচরণ সম্পর্কে সত্য ঘটনা তুলে আনতে পারেন।
- ভবিষ্যৎ-নির্দেশনা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বর্তমান অবস্থার আলোকে ভবিষ্যৎ-সম্পর্কে ধারণা করা যেতে পারে; অর্থাৎ, এ পদ্ধতিতে গবেষক তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে ভবিষ্যতের একটি নির্দেশনা প্রদান করতে পারেন।
পর্যবেক্ষণ-পদ্ধতির অসুবিধাসমূহ:
নিম্নে পর্যবেক্ষণ-পদ্ধতির অসুবিধাসমূহ আলোচনা করা হলো-
- সামাজিক আচরণের এমন কতগুলো বিষয় রয়েছে যেগুলো পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয় না; যেমন-চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, খুন প্রভৃতি। কারণ এগুলো গবেষক সরাসরি পর্যবেক্ষণ করতে পারেন না। এতে বিপদের আশঙ্কা থাকে।
- কোনো ব্যক্তির জীবনেতিহাস যদি দীর্ঘায়িত হয় তবে তার ওপর পর্যবেক্ষণ সম্ভব হয় না। তাছাড়া এ পদ্ধতিতে দীর্ঘসময়ব্যাপী পর্যবেক্ষণ করতে হয় বলে গবেষক তার ধৈর্য ও মনোবল হারিয়ে ফেলেন।
- কতিপয় বিষয় পর্যবেক্ষণরেযাগ্য নয়; যেমন-পারিবারিক সম্পর্ক, যৌনাচার, গোপন সম্পর্ক বৈঠক ইত্যাদি।
- পর্যবেক্ষণ-পদ্ধতিতে দীর্ঘদিন ধরে পর্যবেক্ষণ করতে হয় বিধায় এ পদ্ধতিতে অধিক অর্থের প্রয়োজন হয়। যাতে অনেক সময় গবেষক তার ব্যয়ভার বহন করতে পারেন না। ফলে গবেষণা ব্যর্থতায় পর্যবশিত হন।
- পর্যবেক্ষণ-পদ্ধতির অন্যতম অসুবিধা হলো গবেষক যে ঘটনার ওপর বা বিষয়ে গবেষণা করবেন তার জন্য গবেষককে অপেক্ষা করতে হয়। আবার এ পদ্ধতিতে কোনো ঘটনা, পুনরাবৃত্তিও করা যায় না।
- পর্যবেক্ষকের ব্যক্তিগত পছন্দ, অপছন্দ, আবেগ, অনুভূতি, মনোভাব প্রভৃতি পর্যবেক্ষণের ওপর অবাঞ্ছিত প্রভাব ফেলতে পারে: অর্থাৎ, এর মাধ্যমে পক্ষপাতমূলক তথ্য সংগ্রহের সমূহ সম্ভাবনা থাকে।
- এ পদ্ধতিতে গবেষককে ঘটনার সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত হবার মাধ্যমে আচরণ অনুধ্যান করতে হয়। ফলে তাকে পর্যবেক্ষণীয় এলাকাতে দীর্ঘসময় ব্যয় করতে হয়। ফলে অতি দ্রুত গবেষণা এ পদ্ধতিতে সম্ভব হয়।
- এ পদ্ধতিতে বিস্তৃত ক্ষেত্রগবেষণা সম্ভব নয়। সীমিত পরিধির ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ সম্পর্কে আচরণ অনুধ্যান করা যায়।
উপসংহার
উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, পর্যবেক্ষণ-পদ্ধতিতে কতিপয় অসুবিধা থাকলেও সামাজিক গবেষণায় এ গদ্ধতির ব্যাপক ব্যবহার প্রত্যক্ষ করা যায়। যে সকল ক্ষেত্রে গবেষণাগারের কৃত্রিম পরিবেশে তথ্যানুসন্ধান সম্ভব হয় না। যেখানে স্বাভাবিক পরিবেশ বজায় রেখে যখন প্রত্যক্ষ করা হয় তখন এ পদ্ধতি একটি নির্ভরযোগ্য পদ্ধতিতে রূপলাভ করে। এ পদ্ধতির ক্ষেত্র অনেক বিস্তৃত। অভিজ্ঞ ও দক্ষ পর্যবেক্ষক সুপরিকল্পিত পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আহরণ করতে পারেন।