মানবীয় বিকাশের ক্ষেত্রে পুরালিস্টিক অ্যাপ্রোচ
১৯৭৯-এর দিকে বেক এবং তার সহকর্মীরা কিছু গুরুত্বপূর্ণ ধারণা সহকারে মানব বিকাশের একটি সমন্বিত মডেল (Integrative Model of Development) প্রদান করেন। মোদ্দা কথা, মানবজীবনে বিকাশ যেকোনো সময় ঘটতে পারে। এর কোনো নির্দিষ্ট ধারাবাহিকতা থাকতে হবে এমন কথা নেই। এটা শৈশবে, তারুণ্যে, এমনকি বৃদ্ধকালেও ঘটতে পারে- অর্থাৎ, এটা সরলরেখা হতে হবে এমন কোনো শর্ত সম্ভন নয়। বরং বেশির ভাগের জীবনকালে বিকাশ বিষয়টি বক্ররেখার অনুসারে ঘটতে দেখা গেছে। যেমন, বলা যায় শৈশবে একজন মানুষ অবসরের অনেক সময় পায় যা পূর্ণবয়স্ক হলে খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন। আবার এই ব্যক্তির ক্ষেত্রেই বৃদ্ধ বয়সে অবসরকালীন সময় কাটানোর সুযোগ সৃষ্টি হয়। আবার উলটো দিকে, এমন অনেক বিষয় আছে যা কেবল পূর্ণবয়স্ক সময়ে একজন মানুষের কাছে করে ওঠার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় কিংবা সম্ভব হয়ে ওঠে- অর্থাৎ, অনেক বিষয় আছে যা শৈশব এবং বৃদ্ধ সময়ে অপ্রয়োজনীয় কিংবা অসম্ভব।
যেমন, একজন পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তিই হয়ে উঠতে পারেন একজন দক্ষ দৌড়বিদ। এই তত্ত্বকে পুরালিস্টিক কিংবা বহুত্ববাদী দৃষ্টিতে দেখা হচ্ছে, কেননা জীবনকালের বিকাশ বিষয়টিকে এখানে নির্দিষ্টি অংশে ঘটতে দেখা হচ্ছে না, বরং বিভিন্ন সময়ের প্রেক্ষিতে বিভিন্ন ধারায় একেকজনের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন বিকাশ সাধন হয়।
বেক এবং তার কতিপয় সহকর্মী জীবনকাল বিকাশের ক্ষেত্রে একটি সুসংহত মডেল প্রস্তাব করেছেন (Baltes, Cornelius & Nesselroade, 1980; Baltes, Reese & Lipsitt, 1980; Baltes & Willis, 1979)। এই মডেলের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে।
প্রথমত, বিকাশমূলক প্রক্রিয়াটি জীবনের যেকোনো পর্যায়ে শুরু হতে পারে। আবার এর স্থিতিকাল প্রভাব ও পরিসমাপ্তি ভিন্ন ধরনের হতে পারে। সকল বিকাশমূলক প্রক্রিয়াই জন্ম থেকে কিংবা শিশুবয়সে অথবা নব্য প্রাপ্তবয়সে শুরু হয় না; কিছু কিছু প্রক্রিয়া বৃদ্ধ বয়সেও শুরু হতে পারে।
দ্বিতীয়ত, বিকাশমূলক প্রক্রিয়াগুলো তত্ত্বে দেয়া সকল স্তর বা ধাপ অনুযায়ী সোজাসুজি না-ও চলতে পারে। কিছু কিছু বিকাশ-প্রক্রিয়া ব্যতিক্রমও হতে পারে। যা জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেমন- বাল্যকালে ও বৃদ্ধবয়সে মধ্যবয়সের তুলনায়, একজন ব্যক্তি প্রচুর পরিমাণে মানসম্পন্ন অবসর সময় পার করেন কাজ এবং শিশু লালন-পালনের দায়িত্ব ছাড়াই। কিছু কিছু প্রক্রিয়া আবার বাল্যকালে ও বৃদ্ধবয়সের তুলনায় কম গুরুত্বপূর্ণ- যেমন, একজন ব্যক্তি তার ক্রীড়াবিষয়ক দক্ষতা সবচেয়ে বেশি অর্জন করে মধ্যবয়সে।
তৃতীয়ত, ভিন্ন ভিন্ন বিকাশমূলক প্রক্রিয়া শুরু হয় বিভিন্ন বয়সে এবং সর্বোচ্চ পর্যায়ে বৃদ্ধি পায় এবং কমে যায় ধীরে ধীরে, যদি ব্যক্তি স্বাস্থ্যবান হয়।
চতুর্থত, ব্যক্তিভেদে বিকাশমূলক প্রক্রিয়া ভিন্নতর হয় এবং এর মাত্রাও ভিন্ন হয় বয়স অনুযায়ী, বিশেষ করে প্রাপ্তবয়সে ও বৃদ্ধ বয়সে।
এইভাবেই, বিকাশ হলো একটি প্লুরালিস্টিক প্রক্রিয়া, যা বিভিন্ন মুহূর্তে শুরু হয় এবং বিকাশের ভিন্ন দৃষ্টিকোণের উপর নির্ভর করে বিভিন্ন পদ্ধতি অনুসরণ করে। উপরন্তু বিকাশের প্রভাব ভিন্ন ধরন নেই বলে একে পুরালিস্টিক বলা হয়। Baltes, Reese & Lipsitt-এর সুসংহত মডেল অনুযায়ী, তিনটি সাধারণ প্রভাবকে চিহ্নিত করা গেছে।
আদর্শ বয়স গ্রেডেড: বয়সের সাথে যেসব জড়িত রয়েছে। কিছু জৈবিক ও সমাজ-সাংস্কৃতিক প্রভাব- যেমন, বাল্যকালে শারীরিক পূর্ণতা কিংবা প্রাপ্তবয়সে পারিবারিক, শিক্ষাবিষয়ক ও পেশাজনিত ক্ষেত্রে জড়িত থাকার বিভিন্ন ঘটনা ইত্যাদি।
আদর্শ ইতিহাস গ্রেডেড: পরিবেশ, সামাজিক বিপর্যয় এবং সামাজিক পরিবর্তনের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ে সমাজের সদস্যদের বিকাশে। এই ঘটনাগুলোর প্রভাব আবার বেশি পড়ে বাচ্চা ও বয়স্কদের মধ্যে- যেমন, যুদ্ধ, অর্থনৈতিক বিপর্যয়, ব্যাপক মহামারী, কিংবা সমাজের ব্যাপক আধুনিকায়ন।
আদর্শহীনতা: কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা যা সবার ক্ষেত্রে ঘটে না, কতিপয় ব্যক্তির উপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে থাকে। যেমন: দুর্ঘটনা, অস্বাভাবিক পেশা পরিবর্তন, অস্থায়ী বেকারত্ব, লটারী জয়, বিবাহ-বিচ্ছেদ ও ধর্মীয় আলোচনা।
এই তিন ধরনের প্রভাবকগুলোর ফলাফল ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া করে সবসময়, ব্যক্তিভেদে এবং আচরণভেদে ভিন্নতা দেখা যায়, এই মডেল অনুযায়ী। Baltes, Reese & Lipsitt (1980) একটি গবেষণা করেন, যেখানে তিনি দেখতে পান যে, বয়স গ্রেডের প্রভাবের ফলাফলগুলো বেশি পড়ে জীবনের গোড়া এবং শেষের দিকে। শৈশব ও যৌবনকালে প্রভাব দেখা যায় ইতিহাস গ্রেডের এবং বাল্যকাল ও বৃদ্ধবয়সে আদর্শহীনতার প্রভাব লক্ষ্যণীয়।