প্রারম্ভিক প্রাপ্তবয়সের বৈশিষ্ট্যসমূহ

প্রারম্ভিক প্রাপ্তবয়স হলো এমন একটি বয়স যেখানে নতুন ধরনের একটি জীবন এবং নতুন সামাজিক প্রত্যাশার সাথে মানুষ অভিযোজিত হয়। এখানে প্রত্যাশা করা একজন তরুণ পিতা/মাতা, স্বামী/স্ত্রী অথবা পরিবারের জীবিকার্জক কর্তা হিসেবে ভূমিকা পালন করবে। এই ভূমিকাগুলোর সাথে সাথে নতুন নতুন আচরণ, আগ্রহ এবং মূল্যায়নও গড়ে উঠবে। প্রাপ্তবয়সের প্রারম্ভে এই উপযোজনের ক্ষেত্রে প্রচুর সমস্যায় পড়তে হয়। কিন্তু এসময় তাদেরকে উপযোজনের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করে থাকে তাদের পিতা-মাতা, শিক্ষক, বন্ধু-বান্ধব এমনকি পরিবারের অন্যান্য সদস্য। 

প্রারম্ভিক প্রাপ্তবয়সের বৈশিষ্ট্যসমূহ

প্রারম্ভিক প্রাপ্তবয়সের বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নে দেয়া হলো:

১. বয়সের স্থিতাবস্থা: 

এটা বলা হয় যে, শৈশব এবং কৈশোর হলো বৃদ্ধির সময় এবং প্রারম্ভিক প্রাপ্তবয়স হলো বয়সের একটি স্থিতাবস্থা। অতীত প্রজন্মের ধারণা ছিল, যখন ছেলে এবং মেয়েরা তাদের আইনগত পরিণত বয়সে পৌঁছে যায়। তখন তাদের উদাসীনতার দিন শেষ হয় এবং তাদের স্থিতাবস্থার সময় চলে আসে। প্রাপ্তবয়সের দায়িত্বও চলে আসে। বর্তমান সময়ে স্থিতাবস্থা বলতে বোঝায় এমন একটি অবস্থা, যেখানে একজন ব্যক্তি তার পরবর্তী জীবনের কাজ-কর্মের চিন্তাভাবনা এবং জীবনসঙ্গী নিয়ে চিন্তা-ভাবনা শুরু করে। কিছু কিছু > তরুণ আবার ভিন্ন পন্থায় তাদের চিন্তাভাবনাকে কাজে লাগায় যা তাদের প্রয়োজন মেটাতে সহযোগিতা করে ও আজীবন সন্তুষ্টি প্রদান করে থাকে। যারা একটু অন্যরকম চিন্তাভাবনা করে থাকে তারা তাদের জীবনসঙ্গী হিসেবে একটু ভিন্ন প্রকৃতির মহিলাদের প্রাধান্য দিয়ে থাকে।

২. সন্তান উৎপাদনমূলক বয়স: 

তরুণ প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে পিতৃত্ব-মাতৃত্বের মাধ্যমে। যারা কৈশোরের শেষের দিকে বিবাহ সম্পন্ন করে তারা পিতৃত্ব-মাতৃত্বের স্বাদ লাভ করে ত্রিশের আগেই। এমনকি তারা পিতামহ বা মাতামহের স্বাদ লাভ করে প্রারম্ভিক প্রাপ্তবয়সেই। যারা লেখাপড়া শেষ না করা পর্যন্ত বিয়ে করে না কিংবা কর্মজীবন শুরু করার পূর্বে বিয়ে করে না তারা মনে করে যে কর্মজীবন শুরু করার পূর্বে বিয়ে করলে তারা পরিবারের খরচের ভার বহন করতে পারবে না। এধরনের মানুষেরা ত্রিশের পূর্বে বিয়ে করতে তেমন আগ্রহী হয় না। যেসকল বিবাহিত মহিলা কর্মজীবী, তারা সাধারণত ত্রিশের পরেই সন্তান ধারণে আগ্রহী হয়। যেসকল পরিবার তাদের প্রাপ্তবয়সের প্রারম্ভেই বিয়ে করে ফেলে তারা অনেক আগেই সন্তান নেয় এবং তারা বড় পরিবারের অধিকারী হয়। তারা সন্তান উৎপাদন করার ক্ষেত্রে এই বয়সটার সর্বোচ্চ ব্যবহার করে।

৩. সমস্যাবহুল বয়স: 

প্রারম্ভিক প্রাপ্তবয়সে প্রচুর সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় একজন মানুষকে। এই সমস্যাগুলো ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতির হয়ে থাকে। ১৯৭০ সালে আমেরিকাতে পরিপক্বতা অর্জনের বয়সসীমা নির্ধারণ করা হয় ১৮ বছর। এসময় প্রাপ্তবয়স্করা অনেক সমস্যার সম্মুখীন হয়, যেগুলোর সাথে তাল মিলিয়ে চলার মতো প্রস্তুতি তাদের থাকে না। এই ১৮ বছর বয়সে তারা ভোট দিতে পারে। নিজের সম্পত্তির মালিক হতে পারে। পিতামাতার অনুমতি ছাড়া বিয়ে করতে পারে। এমন কিছু করতে পারে যখন পরিপক্বতা অর্জনের বয়স ২১ বছর ছিল, তখন তা করতে পারতো না। বর্তমানের এই স্বাধীনতা অর্জন যুবক-যুবতী এবং বাবা-মায়ের জন্য সমস্যার সৃষ্টি করে থাকে।

প্রাপ্তবয়সের শুরুতে, অধিকাংশ আমেরিকান উপযোজনজনিত সমস্যায় পড়ে। পরিপক্বতা অর্জনের বয়স থেকে ৩০ বছর পর্যন্ত বয়সের মধ্যে মানুষ বিয়ে করে, পিতামাতা হয় এবং চাকরি নেয়ার মতো বিষয়ে অভিযোজিত হয়। ত্রিশ থেকে চল্লিশ বছর বয়সের দিকে উপযোজনের কেন্দ্র হয় পারিবারিক সম্পর্কগুলো, কারণ এটা ধারণা করা হয় যে, ৩৫ বছরের পর কোনো নতুন চাকরি পাওয়া বা চাকরি বদল করা অসম্ভব ব্যাপার। ফলে, বেশির ভাগ মানুষই তাদের কর্মক্ষেত্রের সাথে প্রথমদিকেই খাপ খাইয়ে নেয় এবং পরবর্তী সময় পিতৃত্ব-মাতৃত্বজনিত সমস্যাগুলোর সাথে মানিয়ে নেয়ার দিকে মনোযোগ দেয়।

প্রারম্ভিক প্রাপ্তবয়স্করা যেসব সমস্যার সম্মুখীন হয় সেগুলো জটিল এবং সময় ও শ্রমসাধ্য। তাই এই সমস্যাগুলোর একত্রে সমাধান করা সম্ভব হয় না। এটি জটিল, যদিও অসম্ভব নয়, যেমন- একজন ব্যক্তির পক্ষে একই সাথে নতুন একটি পেশার সাথে এবং বৈবাহিত সম্পর্কে উপযোজন করা। আবার বিয়ের প্রথম বছরেই যদি সন্তান জন্ম দেয় তাহলে পূর্বের সমস্যাগুলো নিয়ে এই পিতৃত্ব-মাতৃত্বের দায়িত্ব পালন করা পুরুষ ও নারী উভয়ের ক্ষেত্রেই কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি তারা তাদের সন্তুষ্টিজনক পর্যায়ে যেতে ব্যর্থ হয়। প্রাপ্তবয়সে উপযোজন প্রক্রিয়ায় জটিলতার বিভিন্ন কারণ দেখা যায়। সেগুলো যদিও খুবই প্রচলিত। প্রথমে, প্রাপ্তবয়সে খুব কম মানুষেরই প্রত্যাশা থাকে যে বয়সজনিত সমস্যার সাথে তাদের উপযোজনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি থাকে। স্কুল ও কলেজগুলো পেশার প্রশিক্ষণের জন্য খুবই কম শিক্ষা প্রদান করে। খুব কম স্কুল/কলেজই রয়েছে যেগুলো বিবাহ ও পিতৃত্ব-মাতৃত্বজনিত সমস্যাগুলো সম্পর্কে বিভিন্ন কোর্স রাখে।

যদিও কারো শিশু-রক্ষণাবেক্ষণের অভিজ্ঞতা থাকে তাও কেবল অল্প সময়ের জন্য যখন তার পিতামাতা চাকরিতে থাকে এবং বাচ্চাকে শুধু নিরাপদে রাখাই তার দ্বায়িত্ব থাকে যতক্ষণ না তার পিতামাতা ফিরে আসে। দ্বিতীয়ত, দুটি দক্ষতা একত্রে শিক্ষণের ফলাফল হলো এমন যে এর কোনোটিই শিক্ষণের ক্ষেত্রে ভাল ফলাফল বহন করে না। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে দুই বা ততোধিক ভূমিকা একত্রে নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে উপযোজনটা খুবই ত্রুটিপূর্ণ হয়। একজন প্রারম্ভিক প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির ক্ষেত্রে একত্রে একটি চাকরি ও জীবনসঙ্গী খোঁজাটা একই রকম কষ্টকর ব্যাপার। তৃতীয়ত, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো প্রারম্ভিক প্রাপ্তবয়স্করা কোনো ধরনের সাহায্য পায় না, তাদের সমস্যা সমাধানে যা তারা তাদের ছোট থাকা অবস্থায় বা পূর্বে পেয়েছিল। এটা একাংশে তাদের এবং অনেকাংশে তাদের পিতামাতা এবং শিক্ষকদের ব্যর্থতা। বেশির ভাগ প্রারম্ভিক প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিরা তাদের নতুন অবস্থা নিয়ে অহংকার করে কিন্তু তাতে সে মানিয়ে নিতে পারে না। তারা নতুন অবস্থায় ভালোভাবে বেড়ে উঠতে অন্যের সাহায্য ও উপদেশ নিতে চায় না। পিতামাতা ও শিক্ষকরা তাদের কিশোরদের এই সমস্যা সমাধানে সাহায্য করতে গেলে তারা বলে যে এই ব্যাপারে তারা সক্ষম।

৪. আবেগীয় চাপ তৈরির সময়: 

যখন মানুষ একটি নতুন পরিস্থিতিতে বা নতুন জীবনে প্রবেশ করে তখন তারা সেখানে তাদেরকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থায় আবিষ্কার করে। ১৯৬০ সালে আমেরিকায় যে ছাত্র-দাঙ্গা দেখা দেয়, সেখানে মূল বিষয় ছিল, একজন ছাত্র-ছাত্রী তার জীবনের প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির সমমর্যাদা লাভ করে শিক্ষার্থী অবস্থায় এবং এর পরপরই তাকে জীবনের তাগিদ মেটানোর জন্য বাইরে বের হতে হয়। তারা পৃথিবীকে বা কর্মজীবনকে ছাত্রাবস্থায় খুবই উচ্চাবিলাসী চূড়া থেকে দেখে। বাস্তবে তারা যা দেখে তা পছন্দ করতে চায় না এবং পরিবর্তন করতে চায়।

এখন একদশক বা তারও পরে, এটা দেখে বিস্মিত হতে হয় যে এই বিদ্রোহী ছাত্র- ছাত্রী কীভাবে শান্ত হয়েছে। আমেরিকার মূল বা গতানুগতিক জীবন স্রোতধারায় মিশে গেছে। নিজেদের কৌশলের মূল্যায়নের সুযোগ, তাদেরকে প্রচলিত সামাজিক ধ্যান-ধারণার প্রতি বিরুদ্ধাচরণ না করে, সেগুলোকে নিয়ে জীবনে সফল হবার পথ দেখায়। ফলে, তারা সেসব পেশা দিয়েই তাদের জীবন শুরু করেছিল যা তারা আগে পছন্দ করতো না। এতে করেই তারা যোগ্য কর্মী, পিতামাতা এবং অনুগত নাগরিকের মর্যাদা পেয়ে জীবন-যাপন করছে। প্রারম্ভিক অথবা ত্রিশ বছরের মধ্যবর্তী সময়ে বেশির ভাগ প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিরা তাদের সমস্যা সমাধান করে মানসিকভাবে শান্ত ও স্থির হয়ে যায়। কেউ যদি ত্রিশোর্ধ্ব বয়সেও সমস্যা সমাধানে এবং মানসিক বৈশিষ্ট্যগুলো আয়ত্ত করতে ব্যর্থ হয় তাহলে বুঝতে হবে সে প্রাপ্তবয়সের সাথে সন্তুষ্টিজনক উপযোজন করতে পারছে না। উপযোজন যখন মানসিক বিপর্যয় ত্রিশোর্ধ্বে স্থায়ী হয়, এটি সাধারণত উদ্বেগের প্রকাশ ঘটায়। উদ্বেগগুলো সাধারণত তাদের কাজের সাথে সংশ্লিষ্ট। কারণ তারা বুঝতে পারে যে, যত তাড়াতাড়ি তাদের অগ্রগতি হওয়া দরকার কিন্তু কাজের সাথে তাল মিলিয়ে তারা তা পারছে না, বৈবাহিক বা পিতৃত্ব-মাতৃত্বজনিত সমস্যার কারণে। একজন ব্যক্তি যখন প্রাপ্তবয়সে বুঝতে পারে যে সে জীবনের বড় বড় সমস্যাগুলোর সমাধান করতে পারেনি, তখন তারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয় এমনকি আত্মহত্যার চেষ্টাও করে থাকে।

৫. সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্নতার বয়স: 

আনুষ্ঠানিক লেখাপড়ার সমাপ্তি ও প্রাপ্তবয়সে প্রবেশের মাধ্যমে কর্ম ও বিবাহিত জীবনের শুরু হয়। কিশোর-জীবনের বন্ধু-বান্ধবের সাথে সম্বন্ধ কমে ও পরিবারের বাইরে সামাজিক যোগাযোগের সুবিধা কমে যায়। ফলে, সামাজিকভাবে সুপরিচিত শিশুটি প্রাপ্তবয়সে এসে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, যা এরিকসন 'বিচ্ছিন্নতার সংকট' বলে ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

অনেক প্রারম্ভিক প্রাপ্তবয়স্ক রয়েছে যারা শৈশব ও কৈশোরকালে তাদের বন্ধু- বান্ধবের উপরে নির্ভর করতো। সঙ্গ লাভের ক্ষেত্রে, তারা যখন বাসার কাজের দায়িত্ব পালন করতে যায় তখন তারা তাদের বন্ধুমহল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। স্কুল ও কলেজে যেসব ছেলে-মেয়ে সবার কাছে অনেক প্রিয় ছিল, যারা তাদের বেশির ভাগ সময় বন্ধুদের সাথে কাটাতেন, তারা প্রাপ্তবয়সে এসে এই সামাজিক বিচ্ছিন্নতার সাথে উপযোজন করতে গিয়ে কষ্টের মধ্যে পড়ে। সামাজিক বিচ্ছিন্নতার কারণে যে একাকিত্ব থাকে তা মূলত ক্ষণস্থায়ী এবং দীর্ঘস্থায়িত্ব নির্ভর করে স্কুল/কলেজের মতো সে কত তাড়াতাড়ি ও সন্তোষজনকভাবে সামাজিক সম্পর্ক তৈরি করতে পারে। সফলতা অর্জনের ক্ষেত্রে অবশ্যই তাদের প্রতিযোগিতা করতে হবে অন্যদের সাথে। তার শৈশবের বন্ধুত্বসুলভ আচরণকে প্রতিস্থাপন করতে হবে, প্রাপ্তবয়সের সফল প্রতিযোগিতামূলক আচরণ দ্বারা। এজন্য তাদের বেশির ভাগ সময় ও শক্তি খরচ হয় কাজের পিছনে। যা তাদেরকে সামাজিকতার ক্ষেত্রে কম সময় দিতে বাধ্য করে। ফলে তারা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে, যা তাদেরকে বিচ্ছিন্নতার দিকে নিয়ে যায়।

৬. প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হবার বয়স: 

প্রারম্ভিক প্রাপ্তবয়স্করা তাদের ছাত্রত্ব ও নির্ভরশীলতার ভূমিকা পরিবর্তন করে। প্রাপ্তবয়স্করা আত্মনির্ভর ও প্রতিষ্ঠিত জীবনমান অর্জন করে এবং নতুন দায়িত্ব ধারণ করে ও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়।

তাদের এই দায়িত্ব, প্রতিজ্ঞা ও জীবনমান অনেকদিন স্থায়ী হয়। বার্ড উইক এক্ষেত্রে বলেছেন, একজন মানুষের পক্ষে সারা জীবনের জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু কিছু প্রতিজ্ঞা রয়েছে যেগুলো সারা জীবনের জন্য- যেমন: আপনি পিতা/মাতা হয়েছেন, এর মানে হলো সারা জীবনের জন্যই হয়েছেন। আপনি পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন, এর মানে হলো আপনি ছোটবেলায় ভালো করেছেন এবং একজন অধ্যাপক হিসেবে আপনার জীবনযাপন করার সম্ভাবনা বেশি।

৭. আত্মনির্ভরশীলতার বয়স:

 ১৮ বছর বয়সের সাথে একজন ছেলে বা মেয়ে প্রাপ্তবয়সের বৈধতা পেয়ে যায় ও তারা আত্মনির্ভরশীলতার মর্যাদা বহন করে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই কোনো না কোনোভাবে অন্যের উপর স্বল্প বা দীর্ঘমেয়াদে নির্ভরশীল থাকে। এই নির্ভরশীলতা হতে পারে বাবা-মায়ের কাছে কিংবা শিক্ষা ক্ষেত্রে কোনো ইনস্টিটিউটের বৃত্তির উপর কিংবা সরকারের আর্থিক অনুদান বা ঋণের উপর। কিছু কিছু প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি এই নির্ভরশীলতার প্রতি ক্ষুব্ধ; যদিও তারা বুঝতে পারে যে তাদের পছন্দের চাকরিটির জন্য তাদের একটি প্রশিক্ষণ প্রয়োজন ছিল। অনেকেই তাদের পিতামাতা বা বৃত্তির মাধ্যমে প্রশিক্ষণ শেষ করে যদিও সেখানে তাদের কোনো বক্তব্য থাকে না এ ব্যাপারে, যারা নিজের প্রশিক্ষণের খরচ নিজেই যোগান দেয়।

৮. মূল্যবোধের গঠনকাল: 

প্রাপ্তবয়সে অভিজ্ঞতা ও বিভিন্ন বয়সের মানুষের সাথে সামাজিকতার মাধ্যমে শৈশব ও কৈশোরের যেসব মূল্যবোধ বেড়ে ওঠে সেগুলো মানুষের মধ্যে পরিবর্তিত হয় এবং আরো বৃহৎ ও পরিবর্ধিত হয়ে একটি পরিপক্ব পর্যায়ে উপনীত হয়। যেসব প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি স্কুলজীবনে লেখাপড়া ছেড়ে দেয় তারা পরবর্তী জীবনে বুঝতে পারে লেখাপড়ার গুরুত্ব, যা তাদের সামাজিক ও চাকরি-জীবনে মূল্যবোধ গঠনে ও সফলতায় সহায়তা করতে পারতো। যারা তা বুঝতে পারে তারা আবার স্কুল বা কলেজে পড়াশোনা আরম্ভ করে এবং অনেকেই এমনভাবে পড়ালেখায় উদ্দীপনা পায় যাতে তারা স্কুল বা কলেজের ডিগ্রি নেয়ার পরও আরো কোর্স শেষ করে।

প্রারম্ভিক প্রাপ্তবয়সে মূল্যবোধ পরিবর্তনের পিছনে অনেক কারণ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে তিনটি কারণ খুবই পরিচিত। প্রথমত, যদি একজন প্রারম্ভিক প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিকে প্রবীণ ব্যক্তিরা ভালোভাবে গ্রহণ করে, তাহলে প্রারম্ভিক প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি প্রবীণদের সকল মূল্যবোধ গ্রহণ করে। যেভাবে শৈশব ও কৈশোরে তার বন্ধুমহল থেকে মূল্যবোধ গ্রহণ করেছিল। দ্বিতীয়ত, প্রারম্ভিক প্রাপ্তবয়স্করা আবিষ্কার করে যে বেশির ভাগ সামাজিক দল বিশ্বাস ও আচরণের ক্ষেত্রে কিছু কিছু প্রচলিত কিংবা গতানুগতিক মূল্যবোধ ধারণ করে। বিয়ের পূর্বে যৌনসঙ্গম করাটা কিশোর সমাজ গ্রহণ করলেও প্রাপ্তবয়স্করা এটাকে অশালীন হিসেবে মনে করে। সমাজে গ্রহণযোগ্যতার জন্য তারা প্রেমের সম্পর্কের মাধ্যমে প্রচলিত নিয়মে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। তৃতীয়ত, প্রারম্ভিক প্রাপ্তবয়স্করা যারা দ্রুত পিতা-মাতা হয়, তারা অন্যান্য যেমন অবিবাহিত বা সন্তানহীনদের তুলনায় দ্রুত মূল্যবোধের পরিবর্তন ঘটায়। সাথে সাথে তারা অধিক রক্ষণশীল ও চিরাচরিত প্রথা ও মূল্যবোধের দিকে ঝুঁকে পড়ে। এ পর্যায়ে তাদের মূল্যবোধের মধ্যে সামাজিকতার ছাপ লক্ষ্য করা যায়।

৯. নতুন জীবনধারায় উপযোজন কাল: 

আমেরিকান সামাজিক জীবনে বর্তমান শতাব্দীর পরিবর্তন অন্যান্য যেকোনো বয়সের মানুষের তুলনায় প্রাপ্তবয়স্ক মানুষদের আন্দোলিত করেছে বেশি। প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষদের জীবনধারায় শতাব্দীর এই পরিবর্তনের প্রভাব দেখা দেয় বিশদ পরিসরে। এই বয়সের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো বিবাহ ও পিতৃত্ব- মাতৃত্ব। পূর্বের অবৈধ বিবাহপূর্ব যৌনসঙ্গম এখন প্রচলিত হয়েছে। এক্ষেত্রে জন্মনিয়ন্ত্রণ গর্ভনিরোধক পদ্ধতি ও গর্ভপাত পদ্ধতিও চালু হয়েছে, যেখানে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যর্থ হয়। যারা স্কুল/কলেজে পড়ে তাদের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি দেখা যায়। আগে বিবাহপূর্ব গর্ভধারণকে খারাপ চোখে দেখলেও এখন তা আর দেখা হয় না। বরং বিবাহপূর্বে গর্ভবতী হলে তাকে আরো জাঁকজমকপূর্ণভাবে বিবাহ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিয়ে করা হয়।

প্রারম্ভিক প্রাপ্তবয়স্করা তাদের নতুন জীবনধারার সাথে অভিযোজিত হয়েছে। যেখানে তারা চিরাচরিত জেন্ডার-ভিত্তিক আচরণের পরিবর্তে নতুন পারিবারিক জীবনধারার দিকে মনোযোগ দিয়েছেন। যেখানে রয়েছে বিবাহবিচ্ছেদ, একক মাতা/পিতার পরিবার এবং নতুন পেশাদারি ধরনে তারা অভিযোজিত। যেখানে বৃহৎ ব্যবসা ও শিল্প জগতের চাহিদা পূরণ করা হয়। নতুন কোনো একটি জীবনধারায় উপযোজন করা যদি প্রাপ্তবয়স্কদের পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়ায় তাহলে তাদের শৈশব ও কৈশোরের উপযোজনের যে প্রস্তুতি ছিল তা অনুপযোগী ও সম্পর্কহীন বলে প্রমাণিত হয়। প্রারম্ভিক প্রাপ্তবয়স্কদের খুব কমই প্রস্তুতি রাখে নতুন দায়িত্ব নেয়ার ও দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে পিতা/মাতা কিংবা শুধু পিতা বা মাতা হিসেবে, এমনকি বাহিরে কাজের ক্ষেত্রেও।

১০. সৃজনশীলতার বয়স: 

শৈশব ও কৈশোরের ছেলে- মেয়েদের মতো আচরণ, চলাফেরার ও পোশাক-পরিচ্ছদে অন্যদের মতো নিজেকে নগন্য মনে না করে, প্রারম্ভিক প্রাপ্তবয়স্করা নিজেদের আচরণ, চলাফেরা ও পোশাক পরিচ্ছদ নিয়ে গর্ব করে। কারণ তারা আর পিতামাতা বা শিক্ষকদের বিধি-নিষেধের মধ্যে থাকে না। তারা তখন নিজেদের মতো থাকে, স্বাধীনভাবে যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। যেকোনো ধরনের সৃজনশীল কাজ যা একজন প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষ পছন্দ করে, দক্ষ থাকে, যা ইচ্ছা তা করার সুযোগ পায়, যে কাজে সবচেয়ে বেশি সন্তুষ্টি লাভ করে তাই করতে পারে। কিছু মানুষের অন্তর্নিহিত কিছু সৃজনশীল গুণ থাকে, যা তারা তাদের কর্মজীবনে কাজের মাধ্যমে প্রকাশ করে থাকে। যদিও বিশ বছর বয়সেই তারা তাদের আগ্রহ সম্পর্কে বুঝতে পারে। কিন্তু সক্ষমতাগুলো সম্পর্কে অবগত হতে হলে তাদের প্রায় ত্রিশ বা পঁয়ত্রিশ বছর সময় লেগে যায়। এটি তাদেরকে জীবনের সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছানোর সক্ষমতা অর্জনে সহায়তা করবে। কৈশোরে, একজন ছেলের তুলনায় একজন মেয়ে সৃজনশীল কাজকর্মের দিকে সুযোগ বেশি পায়। কারণ সৃজনশীলতাকে জেন্ডারভেদে মেয়েদের জন্যই যথোপযুক্ত বলে মনে করা হয়। যখন মেয়েটি যুবতী বা প্রাপ্তবয়স্ক হয় তখন তার দক্ষতা আরো বেড়ে যায়- যেমন, জামাকাপড় তৈরি, ঘর ডেকোরেশন কিংবা তাদের শখ, এসব দিক দিয়ে মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে আগ্রহী। ফলে অর্জনের দিক দিয়েও মেয়েরা এগিয়ে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url