এডলারের 'ব্যক্তি মনোবিজ্ঞান' মতবাদ
আলফ্রেড এডলার ফ্রয়েডের খুবই কাছের এবং বন্ধুসুলভ ব্যক্তি ছিলেন। প্রথমদিকে ফ্রয়েডের মনঃসমীক্ষণ মতবাদের সমর্থন করেন। কিন্তু পরবর্তীকালে ফ্রয়েডের সাথে তাঁর মত-পার্থক্য সৃষ্টি হয়। তিনি ফ্রয়েডের কাম-প্রবৃত্তি বিরোধিতা করেন এবং তিনি মানুষকে যৌনসর্বস্ব প্রাণীরূপে ভাবতে পারেন নি। তাই আলফ্রেড এ্যাডলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ Neo-Freudian Psychoanalyst। আলফ্রেড এডলার স্বাধীনভাবে তাঁর ধ্যান ধারণার বিকাশ ঘটাতে থাকেন এবং ১৯১৩ খ্রীষ্টাব্দে তাঁর মতবাদকে 'ব্যক্তি মনোবিজ্ঞান" নামে আখ্যায়িত করে জনসমক্ষে উপস্থাপন করেন। অ্যাডলার তার তত্ত্বে মানুষের সামাজিক ও মানবীয় দিকের উপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। সেজন্যই তাঁকে 'মানবীয় মনোবিজ্ঞান'-এর পথপ্রদর্শক রূপে গণ্য করা হয়।
ব্যক্তি মনোবিজ্ঞান
এ্যাডলার ব্যক্তিত্বের তত্ত্ব কয়েকটি মৌলিক ধারণা উপস্থাপন করেছেন। নিম্নে তা আলোচনা করা হলো:
১. শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের সংগ্রাম
সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে মানুষ অনবরত নিজেকে উন্নতর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার সংগ্রামে লিপ্ত থাকে। ফলে মানুষের সুপ্ত প্রতিভা ও শক্তিসমূহ ক্রমশ উজ্জীবিত ও বাস্তবায়িত হতে পারে এবং মানুষ নিজেকে ক্রমান্বয়ে উন্নতন্তরে নিয়ে যেতে পারে। শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের সংগ্রামের তিনটি স্তর লক্ষ করা যায়। যথা:
- হীনম্মন্যতাবোধ: সংগ্রামের উৎস (Feeling Inferiority: Source of striving): হীনম্মন্যতা হলো এমন এক অনুভূতি, যা ব্যর্থতা থেকে দেখা দেয়। মানুষ তাদের হীনম্মন্যতার অনুভূতি কাটিয়ে উঠতে অব্যাহতভাবে সংগ্রাম করে যাচ্ছে।
- হীনম্মন্যতার জটিলতা (Inferiority complex): এ্যাডলারের মতে, যখন কোনো ব্যক্তি বার বার চেষ্টা করেও দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে ব্যর্থ বা প্রত্যাশিত শ্রেষ্ঠত্ব পুরোপুরি অর্জনে অক্ষম হয় তখন তার মধ্যে 'Inferiority complex'দেখা যায়।
- শ্রেষ্ঠত্ব জটিলতা (Superiority complex): শ্রেষ্ঠত্ব জটিলতা প্রত্যয়টি মানুষের আচরণের একটি অস্বভাবিক দিক আলোকপাত করতে ব্যবহার করেন। এক্ষেত্রে ব্যক্তিরা নিজেকে অন্যদের চেয়ে উচ্চগুণ-সম্পন্ন এবং প্রতিভাধর হিসেবে প্রচার করে নিজেদের হীনম্মন্যতা থেকে মুক্তি পেতে চায়।
২. ক্ষতিপূরণ ও অতিক্ষতিপূরণ
এডলার হীনম্মন্যতার অনুভূতি কাটিয়ে ওঠার কার্যক্রমের অনুপ্রেরণার ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ ও অতিক্ষতিপূরণ প্রত্যয় ব্যবহার করেন।
৩. সামাজিক আকর্ষণ
এ্যাডলার মানব চরিত্রের সামাজিক দিকের ওপর অধিক গুরুত্বারোপ করেছেন। মানবাচরণের চালিকাশক্তি রূপে ফ্রয়েড যৌনতাকে গুরুত্ব দিয়েছেন এবং ইয়াং অদিরূপ বা আর্কিস্টাইপের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। কিন্তু এ্যাডলার সামাজিক আকর্ষণকেই মানবাচরণের মূল চালিকাশক্তিরূপে গণ্য করেছেন। মানুষ মূলত সামাজিক জীব বলেই তার সমাজবদ্ধ জীবনের প্রতি তার একনিষ্ঠ আগ্রহ রয়েছে। এই সামাজিক আগ্রহের দ্বারা মুগ্ধ হয়েই মানুষ নিজের ও সমাজের উন্নয়ন সাধনের জন্য নানাবিধ ক্রিয়াকর্মে লিপ্ত হয়ে থাকে।
৪. লাইফ স্টাইল
মনোবিদ এডলার তাঁর ব্যক্তিত্বের তত্ত্বে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যয় হিসেবে লাইফ স্টাইল ব্যবহার করেছেন যা প্রত্যেক ব্যক্তির জীবনযাপনের অনন্য সাধারণ স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উদ্ভূত। এ্যাডলারের মতে, 'Style of life is the idea that each person creats his or her own unique approach to living.' এ্যাডলারের মতে, প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোভাব দ্বারা নিজস্ব লাইফ স্টাইল গড়ে তোলে যা সম্পূর্ণভাবে তার ব্যক্তিগত। এ্যাডলারের মতে, এরূপ লাইফ স্টাইল ব্যক্তির নিজস্ব হীনম্মন্যতার অনুভূতি এবং সেগুলো কাটিয়ে ওঠার কৌশলগত উন্নয়নে ব্যক্তির অনন্য সাধারণ বোধশক্তি থেকে গড়ে ওঠে।
৫. উদ্দেশ্যবাদ
সর্বশেষ কথা হলো লাইফ স্টাইল নিছক অর্থে একটি যান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া নয়। এই ক্ষেত্রে এ্যাডলার ফ্রয়েডের তত্ত্বের সাথে দ্বিমত ব্যক্ত করেন। ফ্রয়েড বলেছেন অতীত ঘটনা বা শৈশবের আঘাতই মানুষের বর্তমানের আচরণের কারণ হিসেবে কাজ করে; অর্থাৎ, অতীতের ঘটনাবলি কারণগত শক্তি রূপে কাজ করে যান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় মানুষকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করে।
৬. ব্যক্তিত্বের প্রকারভেদ
তত্ত্বীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এ্যাডলার ব্যক্তিত্বের শ্রেণিবিভাগ করার বিরোধী ছিলেন। কারণ প্রতিটি মানুষের আপন স্বতন্ত্র ও স্বকীয়তা রয়েছে। এই বাস্তব সুবিধা লাভের জন্যই তিনি ব্যক্তিত্বের শ্রেণিবিভাগ করেছেন এবং মূল বৈশিষ্ট্য অনুসারে চার প্রকার ব্যক্তিত্বের কথা তিনি উল্লেখ করেছেন। নিম্নে চার প্রকার ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:
- শাসক-প্রকৃতি (The ruling type): এ ধরনের ব্যক্তিরা নিজেদেরকে অত্যন্ত ক্ষমতাবান বলে মনে করে এবং সর্বদাই অন্যদের ওপর প্রভুত্ব বিস্তারের চেষ্টা করে।
- প্রাপক-প্রকৃতি (The getting type): এ ধরনের ব্যক্তিরা পরমুখাপেক্ষী ও পরনির্ভরশীল হয়ে পড়ে। নিজেদের সমস্যা সমাধানের জন্য বা স্বীয় কাম্য বস্তু অর্জনের জন্য এরা অতিরিক্ত মাত্রায় অন্যের ওপর নির্ভর করে।
- পলাতক-প্রকৃতি (The avoiding type): এ ধরনের ব্যক্তিরা জীবনের সবরকম সমস্যা ও সংকটকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। এরূপ ব্যক্তি ব্যর্থতাকে অত্যন্ত ভয় পায়। ব্যর্থতার ভয়েই এরা কোনো সমস্যার সম্মুখীন হতে বা কাম্যবস্তু লাভের জন্য প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে পারে না।
- সামাজিক হিতৈষী প্রকৃতি (The socially useful type): এ ধরনের ব্যক্তিদের মধ্যে সামাজিক আগ্রহের পূর্ণ বিকাশ ঘটে। সামাজিক আগ্রহ মানুষের জন্মগত প্রবৃত্তি হলেও তা পূর্ণভাবে বিকাশপ্রাপ্ত হওয়ার জন্য উপযুক্ত শিক্ষা-দীক্ষার প্রয়োজন হয় এবং উপযুক্ত শিক্ষার মাধ্যমেই একটি শিশু সমাজের হিত সাধনকারী ব্যক্তিতে পরিণত হয়। এরূপ ব্যক্তি সমাজের সাথে একাত্ম হয়ে যায় এবং এদের ব্যক্তিগত স্বার্থ সামাজিক স্বার্থের মধ্যে বিলীন হয়ে যায়।
৭. জন্মক্রম
এ্যাডলারের ব্যক্তিত্ব-তত্ত্বের বিশেষ প্রত্যয় হলো জন্মক্রম। ব্যক্তিত্ব বিকাশে যার প্রভাব অপরিসীম। এ্যাডলারের মতে, প্রথম সন্তান পিতামাতার একান্ত যত্নে জীবন শুরু করে। দ্বিতীয় সন্তান জন্ম নেবার পর প্রথম সন্তানের ক্ষেত্রে এর ইতিবাচক অথবা নেতিবাচক উভয় ধরনের প্রভাব পড়তে পারে। দ্বিতীয় সন্তান পিতামাতার আদর-স্নেহের অংশীদার হওয়ায়, প্রথম সন্তানের ব্যক্তিত্বে এর নেতিবাচক প্রভাব যেমন পড়তে পারে, তেমনি আবার ছোটো ভাই-বোনদের প্রতি তাকে দায়িত্বশীল ব্যক্তিত্বেও পরিণত করতে পারে। এ্যাডলার তার ব্যক্তিত্বের তত্ত্বে দ্বিতীয় সন্তান। একেবারে কনিষ্ঠ সন্তান এবং এক সন্তান-এরূপ জন্মক্রমের সম্ভাব্য বিভিন্ন প্রভাবের কথা উল্লেখ করেছেন। ব্যক্তিত্ব গঠনে জন্মক্রমের প্রভাব বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণ হয়েছে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে প্রথম সন্তানের সঙ্গে পিতা-মাতার গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান থাকে। ফলে প্রথম সন্তানেরা পরের সন্তানদের চেয়ে অধিক সফলতা ও স্ব-নিয়ন্ত্রণমুখী ব্যক্তিত্বের অধিকারী হয়। এ্যাডলারের সাধারণ ধারণা হলো জন্মক্রমে ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যা গবেষণায় সত্য বলে প্রমাণ হয়েছে।
এ্যাডলারের তত্ত্বের সীমাবদ্ধতা
সাধারণ মানুষের বোধগম্যের উপযোগী করার জন্য এ্যাডলার তাঁর তত্ত্বকে অত্যন্ত সহজ ও সরলভাবে উপস্থাপন করেছেন এবং মানবাচরণকে ব্যাখ্যা করার জন্য ন্যূনতম সংখ্যক ধারণার অবতারণা করেছেন। তবে এ্যাডলারের তত্ত্বের সরলতাকেই তাঁর তত্ত্বের সীমাবদ্ধতারূপে গণ্য করা হয়। মানুষের বহুবিধ জটিল ও বৈচিত্র্যময় আচরণকে স্বল্পসংখ্যক সূত্র ও ধারণার দ্বারা ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয় বলে অনেকে এ্যাডলারের সমালোচনা করেন।
উপসংহার
পরিশেষে বলা যায় যে, এ্যাডলারকে যতই সমালোচনা করা হোক না কেন, তাঁর তত্ত্বের গুরুত্বকে কোনোক্রমেই অস্বীকার করা যায় না। মানসিক গোলযোগের চিকিৎসা, শিশু প্রতিপালন, শিশু নির্দেশনা ও শিক্ষা-কার্যক্রমের ক্ষেত্রে এ্যাডলারের তত্ত্বীয় ধারণাকে বহুলভাবে ব্যবহার করা হয়।