মনোবিজ্ঞানের সাথে অন্যান্য জ্ঞান শাস্ত্রের সম্পর্ক

মনোবিজ্ঞানের সাথে অন্যান্য জ্ঞান শাস্ত্রের সম্পর্ক

জীবের আচরণ অনুধ্যান মনোবিজ্ঞানের একচেটিয়া অধিকার নয়। জীববিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানের অন্যান্য শাস্ত্রও জীবের আচরণ আলোচনা করে। এজন্য জ্ঞান শাস্ত্রের অন্যান্য শাখার সাথে মনোবিজ্ঞানের প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ সম্পর্ক আছে। অন্যান্য যেসব শাস্ত্রের সাথে মনোবিজ্ঞানের সম্পর্ক আছে সেগুলিকে মোটামুটি তিন ভাগে ভাগ করা যায়। 

(ক) জীববিজ্ঞান : এর মধ্যে মনোবিজ্ঞানের সাথে বিশেষভাবে সম্পর্কযুক্ত হল শারীরতত্ত্ব ও প্রানিবিদ্যা।

(খ) তথাকথিত আচরণ বিজ্ঞান : এর মধ্যে সমাজবিদ্যা, নৃবিদ্যা প্রধান। প্রসঙ্গত মনোবিজ্ঞানের কয়েকটি শাখার ন্যায় সমাজবিদ্যা ও নৃবিদ্যা সমাজবিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত। সাম্প্রতিককালে এসব শাখা আচরণ অনুধ্যানে প্রায় একই ধরনের বস্তুনিষ্ঠ ও সূক্ষ্ম পদ্ধতি অনুসরণ করে বলে এদেরকে আচরণ বিজ্ঞান বলা হয়।

(গ) সমাজবিজ্ঞান : এই জাতীয় বিজ্ঞানের মধ্যে একমাত্র রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। মানুষের অতীত আচরণের ঘটনাবলী আলোচনা করে বলে ইতিহাসকেও এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। জ্ঞানের এসব শাখা আচরণের অনুধ্যানে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করলেও মনোবিজ্ঞানের সাথে তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।

শারীরতত্ত্ব ও মনোবিজ্ঞান (Physiology and Psychology) : 

শারীরতত্ত্ব প্রকৃতপক্ষে আচরণই আলোচনা করে। কিন্তু তাই বলে সব সময় একে আচরণ বিজ্ঞান হিসেবে বিবেচনা করা ঠিক নয়। এটি শরীরাভ্যন্তরের বিভিন্ন অঙ্গ তথা হৃৎপিণ্ড, পাকস্থলী, মাংসপেশী, শিরা-উপশিরা এবং আন্তর্যন্ত্রের গঠন ও কার্যাবলী আলোচনা করে। যেমন পরিপাকতন্ত্র, রক্তসঞ্চালনতন্ত্র, ৱায়ুতন্ত্র, গ্রন্থিতন্ত্র ইত্যাদি। শারীরতত্ত্ব শুধুমাত্র দেহতন্ত্রগুলিকে এককভাবে আলোচনা করে না। বরং একটি তন্ত্রের সাথে অন্য একটি তন্ত্র কিভাবে সম্পর্কযুক্ত, কিভাবে তারা একে-অন্যের সাথে সহযোগিতা করে, কিভাবে তারা পরস্পরের সাথে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া করে সবই এর আলোচ্য বিষয়বস্তুর অন্তর্গত। অন্যকথায় বলা যায় কিভাবে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এবং তন্ত্রগুলি কাজ করে তাই শারীরতত্ত্বের প্রধান আলোচ্য বিষয়। একটু ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে মনোবিজ্ঞান এসব বিষয় আলোচনা করে। বাইরের পরিবেশ, আবহাওয়া কিংবা কোন জরুরী পরিস্থিতির সাথে সঙ্গতিবিধানের জন্য শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের কি কাজ এবং কিভাবে সেগুলি জীবের প্রতিক্রিয়া অর্থাৎ আচরণকে প্রভাবিত করে মনোবিজ্ঞান তাই আলোচনা করে। সুতরাং মনোবিজ্ঞানের আলোচনা আচরণমুখী। যেমন কোন ভীতিপ্রদ পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে গিয়ে একজন ব্যক্তি তীরবেগে ছুটে বাড়িতে এল। তারপর দেখা গেল সে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে, তার গা দিয়ে ঘাম ঝরছে, বুক ধড়ফড় করছে, নাড়ির স্পন্দন বেড়ে গেছে, রক্তচাপ বেড়ে গেছে ইত্যাদি। এসব আচরণের পিছনে শরীরের কোন অংশের কি কাজ তা আলোচনা ও বিশ্লেষণ করতে গিয়েই মনোবিজ্ঞান ও শারীরতত্ত্ব পরস্পর সম্পর্কযুক্ত হয়ে পড়েছে। আচরণের সাথে শারীরিক উপাদানের সম্পর্ক নির্ধারণ করেই শারীরস্থানবিদ (anatomist) ও শারীরতত্ত্ববিদরা মনোবিজ্ঞানের বিকাশে বিশেষ অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছেন।

জীববিজ্ঞানীরা বিভিন্ন পরিবেশ এবং বিভিন্ন ভৌগোলিক অবস্থানে বসবাসরত প্রাণীকুল পর্যবেক্ষণ করে তাদেরকে বিভিন্ন শ্রেণীতে ভাগ করেন। শারীরিক গঠনের দিক থেকেও তাঁরা প্রাণীকে বিভিন্ন শ্রেণীতে ভাগ করে থাকেন। এক এক পরিবেশে কিংবা এক এক ভৌগোলিক অবস্থানে কি জাতের প্রাণী বাস করে সে সম্পর্কে অবহিত হয়েই মনোবিজ্ঞানীরা পরিবেশের সাথে তাদের সঙ্গতিবিধানের ধারা সম্পর্কে নতুন নতুন তথ্য খুঁজে পান। তাছাড়া প্রাণীকুলের শ্রেণীবিন্যাস করতে গিয়ে জীববিজ্ঞানীরা যেসব অনুসন্ধান চালিয়েছেন প্রাণী আচরণ বুঝবার জন্য সেগুলি মনোবিজ্ঞানকে যথেষ্ট সহায়তা করেছে।

মনোবিজ্ঞান ও নৃবিদ্যা (Phychology and Anthropology) : 

আভিধানিক অর্থে মানুষকে কোন বৃহৎ গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত করে আলোচনা করাই নৃবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু। ভৌত নৃবিজ্ঞান (physical anthropology) এবং কৃষ্টি নৃবিজ্ঞান (cultural anthropology) নামে এর দুটি শাখা আছে। ভৌত বিজ্ঞান বিশ্বের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর শারীরিক বৈশিষ্ট্য আলোচনা করে। যেমন তাদের বংশ, ওজন, আকৃতি অথবা একই সাথে তার বুদ্ধিবৃত্তি ও আবেগ সংক্রান্ত বৈশিষ্ট্য প্রভৃতির আলোচনা এ শাখার বিষয়বস্তুর অন্তর্ভুক্ত। অন্যপক্ষে কৃষ্টি নৃবিজ্ঞান বিভিন্ন প্রাচীন সভ্যতা ও তার আদর্শ, একটি বিশেষ সভ্যতার অন্তর্গত আদর্শ, ব্যক্তিত্ব ও তার বিকাশের ওপর কৃষ্টির প্রভাব ইত্যাদি বিষয় আলোচনা করে।

“কোন বিশেষ সভ্যতার বৈশিষ্ট্য আলোচনা করতে গিয়ে একজন নৃবিদ তার সামাজিক রীতিনীতি, কৃষ্টির অন্তর্ভুক্ত জনগোষ্ঠী আচরণের বৈশিষ্ট্য এবং কিভাবে তারা জরুরী অবস্থার মোকাবেলা করে, কিভাবে তারা উৎসবাদি পালন করে, এককথায় তাদের সামাজিক আচার- অনুষ্ঠান আলোচনা করে। মনোবিজ্ঞান ঐ জনগোষ্ঠীর ব্যক্তিগত ও সামাজিক আচরণ আলোচনা করে। আচরণের যথার্থ বিশ্লেষণে মনোবিজ্ঞান ব্যক্তিকেই প্রাধান্য দেয়। অন্যপক্ষে নৃবিজ্ঞান একটি বিশেষ সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত জনগোষ্ঠীর কৃষ্টি ও তাদের শারীরিক বৈশিষ্ট্যের ওপর বিশেষ জোর দিয়ে থাকে। নৃতত্ত্ব প্রাচীন সমাজগোষ্ঠীর কৃষ্টিগত বৈশিষ্ট্য এবং সামাজিক কাঠামো আলোচনা করে। প্রকৃত অর্থে মানুষের আচরণ বুঝতে হলে তার কৃষ্টি ও সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত জনগোষ্ঠী তাদের সভ্যতাকে কোন দৃষ্টিতে দেখে, নিজেদের ও বাইরের সভ্যতা সম্পর্কে তাদের মনোভাব কি তাও জানা দরকার। এভাবে দেখা যায় মনোবিজ্ঞান ও নৃবিজ্ঞান মনুষ্য আচরণের কতকগুলি সাধারণ বিষয় আলোচনা করে একে-অন্যের সহায়ক ও সম্পূরক হিসেবে কাজ করে।

মনোবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান (Psychology and Sociology) : 

সমাজবিজ্ঞান প্রত্যক্ষভাবে মানুষের সামাজিক আচরণ আলোচনা করে। এটি ব্যক্তিকে কোন বিশেষ সমাজ বা সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত কোন গোষ্ঠীর সাথে সম্পর্কযুক্ত করে তার আচরণ আলোচনা করে। বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা যেমন সামাজিক অপরাধ, বিবাহ বিচ্ছেদ, পারিবারিক বিশৃঙ্খলা, পরিবারের বিকাশ ও তার কাঠামোগত পরিবর্তন, যুদ্ধবিগ্রহ, বংশ, জাতি বা গোষ্ঠীর মধ্যে দ্বন্দ্ব, সংঘাত ইত্যাদি এ শাস্ত্রের আলোচ্য বিষয়বস্তুর অন্তর্ভুক্ত। মানুষের এসব সামাজিক আচরণ, ব্যক্তির ওপর বিভিন্ন সামাজিক শক্তির প্রভাব, কিভাবে এসব শক্তি ব্যক্তিত্বের ওপর ক্রিয়া করে সবই নিজস্ব পদ্ধতিতে সমাজবিজ্ঞান আলোচনা করে। মনোবিজ্ঞানের একটি বিশেষ শাখা হিসেবে সমাজ মনোবিজ্ঞানও মানুষের এসব সামাজিক আচরণ আলোচনা করে। সমাজ মনোবিজ্ঞান তিন ধরনের সামাজিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করে। এগুলি হল ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির সম্পর্ক, ব্যক্তির সাথে দলের সম্পর্ক এবং দলের সাথে দলের সম্পর্ক।

সুতরাং ব্যক্তি আচরণের ওপর দলীয় আচরণের প্রভাব এবং দলীয় আচরণের ওপর ব্যক্তি আচরণের প্রভাব আলোচনা সমাজ মনোবিজ্ঞানের বিষয়বস্তুর অন্তর্গত। মানুষের সামাজিক আচরণ আলোচনা করতে গিয়ে মনোবিজ্ঞান সমাজবিজ্ঞান থেকে বেশ কিছু তথ্য ধার নিয়ে থাকে। কোন কোন ক্ষেত্রে উভয়ে একসঙ্গে একই সমস্যা আলোচনা করে। সেক্ষেত্রে একে-অন্যের সহযোগী ও সহায়ক হিসেবে কাজ করে। কারণ ব্যক্তির সামাজিক আচরণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে গোষ্ঠীর সামাজিক কাঠামো ও বৈশিষ্ট্য জানার প্রয়োজন হয়। আর সমাজবিজ্ঞানই মনোবিজ্ঞানকে এই জ্ঞান সরবরাহ করে।

মনোবিজ্ঞান ও অন্যান্য সমাজবিজ্ঞান (Psychology and other Social Sciences ) : 

অন্যান্য সমাজবিজ্ঞানের মধ্যে অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাস মানুষের আচরণ আলোচনা করে। এসব শাখা পৃথকভাবে ব্যক্তি আচরণের এক একটি বিশেষ দিক নিয়ে আলোচনা করে। ইতিহাস আলোচনা করে মানুষের অতীত আচরণের ধারা। অর্থনীতি আলোচনা করে মানুষের অর্থনৈতিক আচরণ, সমাজজীবনে মানুষের সীমিত আয় ও তার সাহায্যে চাহিদা পূরণের সামাজিক রীতিনীতি এবং ব্যবসায়ের নিয়মকানুনও এর আলোচ্য বিষয়বস্তুর অন্তর্গত। রাষ্ট্রবিজ্ঞান মানুষের রাজনৈতিক আচরণ তথা বিভিন্ন ধরনের সরকার বা সরকার সংগঠনের কাঠামো, বৈশিষ্ট্য ও কার্যাবলী আলোচনা করে। প্রকৃতপক্ষে জ্ঞানের এসব শাখা আংশিকভাবে মনুষ্য আচরণ সম্পর্কিত ঐতিহাসিক বিজ্ঞানও বটে। কারণ এসব শাখা এক একটি বিশেষ প্রেক্ষাপটে পর্যবেক্ষণ পদ্ধতির সাহায্যে মনুষ্য আচরণের অতীত ঘটনাবলীর বিবরণ দেয় ও বিশ্লেষণ করে থাকে। সঠিকভাবে বলতে গেলে মনোবিজ্ঞান মানুষের সব ধরনের আচরণের বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা করে। আচরণকে পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করে সে সম্পর্কে সাধারণ নিয়ম প্রণয়ন করে। সুতরাং সূক্ষ্মভাবে বিচার করলে দেখা যায় মনোবিজ্ঞান অন্যান্য সমাজ বিজ্ঞান ও জীববিজ্ঞানের মিলনক্ষেত্র হিসেবে কাজ করে। আচরণ আলোচনায় এসব শাখার নির্দিষ্ট কোন সীমারেখা নির্ধারণ করা বেশ কঠিন। তবে প্রত্যেকটি শাখা আচরণকে তার নিজস্ব আওতার মধ্যে রেখে নিজস্ব পদ্ধতি ও প্রক্রিয়ার সাহায্যে বিশ্লেষণ করে। অনেক সময় এমনও হয় যে পাশাপাশি থেকেও তারা একে-অন্যের অজ্ঞাতসারে একই বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে।

মনোবিজ্ঞান ও সমাজকর্ম বা সমাজকল্যাণ (Psychology and Social Work or Social Welfare) :

সাম্প্রতিককালে সমাজকল্যাণ বা সমাজকর্ম নামে সমাজবিজ্ঞানের আরও একটি শাখার উদ্ভব ঘটেছে। সমাজকল্যাণ বা সমাজকর্ম বিষয়টি প্রাচীনকাল থেকে চলে এলেও পাঠ্য বিষয় হিসেবে এর স্বীকৃতি এবং পেশাগত মর্যাদালাভ খুব বেশি দিন আগে ঘটেনি। তবুও মানবকল্যাণে এর অবদান বেশ উল্লেখযোগ্য। সীমিত সম্পদ ও আয়ের সাহায্যে একজন ব্যক্তি অথবা নির্দিষ্ট এলাকার কোন জনসমষ্টি কিভাবে তার মৌলিক চাহিদা পূরণের ক্ষমতা অর্জন করতে পারে তাই এর আলোচ্য বিষয়। পেশাদার সমাজকর্মী ব্যক্তি অথবা জনসমষ্টিকে আত্মপ্রতিষ্ঠা শিক্ষাদানের সময় ব্যক্তি বা জনসমষ্টিকে যখন শিক্ষা দেন। তখন তিনি প্রধানত মনোবিজ্ঞানের আচরণ সম্পর্কিত জ্ঞানগুলি কাজে লাগিয়ে থাকেন। ব্যক্তি বা সমষ্টি উন্নয়নে তাদের আত্মবিশ্বাস সৃষ্টিতে সমাজকর্মী মনোবিজ্ঞানের প্রেষণা, প্রত্যক্ষণ, শিক্ষণ, মনোভাব ইত্যাদি আচরণের সাধারণ সূত্রগুলি প্রয়োগ করে থাকেন। তাঁর কাজের সফলতা সাধারণত মনোবিজ্ঞানের জ্ঞানকে কাজে লাগানোর ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে। এজন্য মনোবিজ্ঞানের সাথে সমাজকর্ম বা সমাজকল্যাণ ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url