মনোবিজ্ঞান কি বিজ্ঞান?

মনোবিজ্ঞান কি বিজ্ঞান?

বিষয়বস্তু আলোচনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে যে মনোবিজ্ঞান কলা ও বিজ্ঞান দুই-ই (Morgan, 1966)। তবে মনোবিজ্ঞান বিজ্ঞান হিসেবেই স্বীকৃত। কিন্তু যেহেতু এটি কলা ও বিজ্ঞান দুই-ই সেহেতু প্রশ্ন ওঠে মনোবিজ্ঞান যথার্থ বিজ্ঞান কি-না। এ প্রশ্নের উত্তরে জানা দরকার বিজ্ঞান কি? এর বৈশিষ্ট্যবা কি কি? আর মনোবিজ্ঞানের এসব বৈশিষ্ট্য আছে কি-না?

বিজ্ঞান' শব্দের আভিধানিক অর্থ বিশেষ জ্ঞান। অবশ্য সব জ্ঞানই বিজ্ঞান নয়। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোন বিশেষ বস্তু বা ঘটনা সম্পর্কে সুসংবদ্ধ জ্ঞানই বিজ্ঞান। এই জ্ঞান যথাযথ পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষণ ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে অর্জিত হয়। যেসব বস্তু বা ঘটনা পর্যবেক্ষণ করা হয় সেগুলি বিভিন্ন পদ্ধতিতে সুসংবদ্ধ করা হয়। বিজ্ঞানের প্রাথমিক কাজ বস্তু ও ঘটনাবলীর শ্রেণীবিভাগ করা। তারপর শ্রেণীবদ্ধ বস্তু বা ঘটনা সম্পর্কে সাধারণ সূত্র প্রণয়ন করা যার সাহায্যে ঐ জাতীয় বস্তু বা ঘটনাকে ব্যাখ্যা করা যায়। মনোবিজ্ঞান মানুষ অথবা প্রাণীর আচরণ পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষণ, বিশ্লেষণ এবং পরিমাপের সাহায্যে নানাবিধ সাধারণ সূত্র প্রণয়ন করছে। এসব সূত্রের সাহায্যে অনেক আচরণের ব্যাখ্যা প্রদান করছে। শুধু তাই নয় অনেক আচরণ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করাও সম্ভব হচ্ছে। এ কারণেই মনোবিজ্ঞানকে বিজ্ঞানের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। এছাড়াও মনোবিজ্ঞানে বিজ্ঞানের অন্যান্য বৈশিষ্ট্যও বিদ্যমান।

(১) বিজ্ঞান সর্বদা পর্যবেক্ষণযোগ্য বস্তু বা ঘটনা নিয়ে আলোচনা করে। পর্যবেক্ষণযোগ্য নয় এমন বস্তু বা ঘটনা বিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয় হতে পারে না। পদার্থবিজ্ঞান বিভিন্ন জড় পদার্থের ভৌতিক ধর্ম, গুণ ও ক্রিয়া সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান আহরণ করে। রসায়নশাস্ত্র বিভিন্ন দ্রব্যের রাসায়নিক ধর্ম, গুণ ও ক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করে। জীববিজ্ঞান বিভিন্ন প্রাণীর আচরণ ও দৈহিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে তথ্য আহরণপূর্বক তাদের শ্রেণীবিভাগ করে। মনোবিজ্ঞান অস্তিত্বহীন অদৃশ্য মন বা আত্মাকে বাদ দিয়ে জীবের পর্যবেক্ষণযোগ্য আচরণকেই বিষয়বস্তু হিসেবে বেছে নিয়েছে। অন্যান্য বিজ্ঞানের মতো মনোবিজ্ঞান জীবের আচরণ পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষণ ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে নতুন নতুন তথ্য আহরণ করতে সক্ষম হয়েছে। আচরণ পর্যবেক্ষণযোগ্য ও পরিমাপযোগ্য। সুতরাং এর বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ সম্ভব।

(২) বিজ্ঞানের জ্ঞান সর্বদা বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যনির্ভর। এই জ্ঞান তর্কনির্ভর কিংবা ব্যক্তির মতামত বা বিশ্বাসের ওপর নির্ভরশীল নয়। পরীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে প্রাপ্ত বাস্তব জ্ঞানই বিজ্ঞান। মনোবিজ্ঞানীরা জীবের আচরণ নিয়ে গবেষণা করেন। পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষণ ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে আচরণ সম্পর্কে যে তথ্য পাওয়া যায় তাই আচরণের বৈজ্ঞানিক জ্ঞান। এক্ষেত্রে পরীক্ষক, পর্যবেক্ষক বা বিশ্লেষকের নিজস্ব মতামত বা বিশ্বাসের কোন অবকাশ নেই।

(৩) বিজ্ঞানের জ্ঞান সর্বদা আদান-প্রদানযোগ্য। এই জ্ঞান এক ব্যক্তির কাছ থেকে অন্য ব্যক্তির কাছে স্থানান্তরিত করা যায়। একজন পরীক্ষক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে কোন তথ্য উদ্ঘাটন করলে অন্য কোন বৈজ্ঞানিক উদ্ঘাটিত তথ্যের প্রতিবেদন পড়ে তা আয়ত্ত করতে পারেন। কেননা বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ব্যক্তিনিরপেক্ষ। মনোবিজ্ঞান পরীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে আচরণ সম্পর্কে যেসব নতুন নতুন তথ্য আবিষ্কার করছে অন্য কোন ব্যক্তি তা পাঠ করে আয়ত্ত করতে পারে। ইচ্ছা করলে অন্য কোন মনোবিজ্ঞানী পরীক্ষণের মাধ্যমে তা যাচাই করেও দেখতে পারেন।

(৪) বিজ্ঞানের জ্ঞান কোথাও থেমে থাকে না। এই জ্ঞান প্রগতিশীল এবং সদা সম্মুখে অগ্রসরমান। বিজ্ঞানের জ্ঞান কখনও সম্পূর্ণ হতে পারে না। একবার কোন নতুন তথ্য উদ্ঘাটিত হলে পরবর্তীতে অন্য কোন বিজ্ঞানী গবেষণার মাধ্যমে তা পরিশোধন বা পরিমার্জন করতে পারেন। এভাবে পদার্থবিজ্ঞান এবং রসায়নশাস্ত্রের বহু আবিষ্কৃত তত্ত্ব ও তথ্যের পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। অনুরূপভাবে জীবের আচরণ সম্পর্কে মনোবিজ্ঞানীরা অতীতে যেসব তথ্য উদ্ঘাটন করেছেন বর্তমানে তার অনেকগুলি সংশোধিত হয়েছে। যেমন মূর্ছা রোগ সম্পর্কে অতীতে বলা হতো জরায়ুর স্থানচ্যুতির ফলেই এবং একমাত্র মেয়েদেরই এই রোগ হয়। কিন্তু বর্তমানে প্রমাণিত হয়েছে যে মূর্ছা রোগ মানসিক কারণে ঘটে এবং ছেলে-মেয়ে উভয়ই এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। যতদিন এ সম্পর্কে আর কোন নতুন তথ্য উদ্ঘাটিত না হবে ততদিন মূর্ছা রোগ সম্পর্কে এই মতবাদই গ্রহণযোগ্য থাকবে। এভাবে পুরাতন তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই বিজ্ঞানে নতুন নতুন তথ্যের আবির্ভাব ঘটে। একেই বলা হয় বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল অনুসন্ধিৎসা। একটা তথ্য পাওয়া গেলে তার ওপর ভিত্তি করেই আরও নতুন তথ্য খুঁজে বের করা ও পুরাতন তথ্য যাচাই করার প্রবণতাই বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি। মনোবিজ্ঞান আচরণ সম্পর্কে পুরাতন জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে নতুন নতুন জ্ঞান আহরণের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

(৫) বিজ্ঞানের বিশেষ উদ্দেশ্য হল বস্তু বা ঘটনার পরীক্ষণ, পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে তার ব্যাখ্যা করা এবং সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট সর্বজনগ্রাহ্য সাধারণ নিয়ম আবিষ্কার করা। পদার্থবিজ্ঞান বিভিন্ন জড়পদার্থ নিয়ে পরীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তাদের ধর্ম, গুণ ও ক্রিয়া বিশ্লেষণপূর্বক জড়জগৎ সম্পর্কে কতকগুলি সাধারণ নিয়ম আবিষ্কার করেছে। যেমন মাধ্যাকর্ষণ সূত্র। অন্যান্য প্রাকৃতিক বিজ্ঞানেরও মূল লক্ষ্য হল বিভিন্ন বস্তু বা ঘটনা বিশ্লেষণপূর্বক সে সম্পর্কে সাধারণ সূত্র প্রণয়ন করা এবং এই নিয়মের সাহায্যে ঐ জাতীয় বস্তু বা ঘটনার ব্যাখ্যা করা। অনুরূপভাবে মনোবিজ্ঞান ও গবেষণার মাধ্যমে জীবের আচরণ বিশ্লেষণপূর্বক এ সম্পর্কে বহু সাধারণ নিয়ম আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছে। এসব সূত্রের সাহায্যে মানুষ ও প্রাণীর বহু আচরণ ব্যাখ্যা করা সম্ভব হচ্ছে।

(৬) বিজ্ঞানের আরো একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য এর পদ্ধতি। বিজ্ঞানের জ্ঞান কতখানি সত্য তা নির্ভর করে কিভাবে এই জ্ঞান আহরণ করা হয়েছে তার ওপর। বিজ্ঞানের সকল জ্ঞানই তথ্যনির্ভর। আর এই জ্ঞান বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সাহায্যে আহরণ করা হয়। এসব পদ্ধতির মধ্যে সবচেয়ে সুনিয়ন্ত্রিত পরীক্ষণ পদ্ধতির ব্যবহার বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। পরীক্ষণ পদ্ধতি হল নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে পরীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বিষয়বস্তু সম্পর্কে যেসব তথ্য পাওয়া যায় সেগুলিকে একত্র করে একটি সাধারণ সূত্র প্রণয়ন করা এবং পুনরায় ঐ একই প্রক্রিয়ায় প্রাপ্ত তথ্যের যথার্থতা যাচাই করে তাকে সার্বজনীন নিয়ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। মনোবিজ্ঞান মানুষ ও প্রাণীর আচরণ পর্যবেক্ষণের জন্য প্রধানত পরীক্ষণ পদ্ধতি অনুসরণ করে। মনোবিজ্ঞানীরা আচরণ পর্যবেক্ষণ করেন, পরীক্ষণের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে আচরণ সম্পর্কে সাধারণ সূত্র আবিষ্কার করেন এবং পুনঃপরীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তার যথার্থতা বিচার করে সূত্রটিকে সর্বজনগ্রাহ্যরূপে প্রতিষ্ঠিত করেন।

(৭) বিজ্ঞানের জ্ঞান যথার্থ কি-না তার আর একটি মাপকাঠি হল এর প্রয়োগশীলতা। বিজ্ঞানের প্রত্যেকটি শাখার সার্বজনীন নীতি মানবকল্যাণে বাস্তবে কাজে লাগানো হয়। মনোবিজ্ঞানও এদিক দিয়ে পিছিয়ে নেই। পরীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে মনোবিজ্ঞান মানুষ ও প্রাণীর আচরণ সম্পর্কে যেসব সাধারণ সূত্র আবিষ্কার করছে সেগুলি প্রয়োগের মাধ্যমে মনোবিজ্ঞান বাস্তব ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছে। মানব জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এসব সূত্র প্রয়োগের ফলেই মনোবিজ্ঞানের বিভিন্ন ফলিত শাখার উদ্ভব ঘটেছে। শিল্প মনোবিজ্ঞান, শিক্ষা মনোবিজ্ঞান, চিকিৎসা মনোবিজ্ঞান এগুলির মধ্যে অন্যতম।

উপরের আলোচনা থেকে দেখা যায় বিজ্ঞানের সকল বৈশিষ্ট্যই মনোবিজ্ঞানের মধ্যে বিদ্যমান। সুতরাং মনোবিজ্ঞান যথার্থই বিজ্ঞান। তবে এটি অন্যান্য প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মতো তত নিখুঁত নয়। সাধারণভাবে এটা ধরে নেয়া হয় যে বিজ্ঞানের সকল শাখাই পরীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তার উপাত্ত সংগ্রহ ও পরিমাপ করে। যে শাখার পরিমাপ যত বেশি সূক্ষ্ম ও নিখুঁত সে শাখা তত বেশি বিজ্ঞানসম্মত। এই হিসেবে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানগুলির মধ্যে পদার্থবিদ্যা সবচেয়ে বেশি বিজ্ঞানসম্মত। জীববিদ্যা বিজ্ঞান হলেও বিশেষ বিশেষ বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে প্রাণীকুলের যে সুসংবদ্ধ শ্রেণীবিভাগ জীববিদ্যা করে তা অন্যান্য বিজ্ঞানের তুলনায় অনেক স্থুল। মনোবিজ্ঞানেও আচরণের এ ধরনের পরিমাপ ও শ্রেণীবিভাগ করা হয়। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আচরণ সমস্যাগুলির শ্রেণীবিভাগ ও পরিমাপ কম' বা বেশি' এই জাতীয়।

মনোবিজ্ঞানের উপাত্তগুলো পরিসংখ্যান পদ্ধতিতে বিশ্লেষণের ভিত্তিতে গৃহীত বা বর্জিত হয়। কারণ জীবের আচরণ পরিবর্তনশীল। এই আচরণ পদার্থবিদ্যা ও রসায়নশাস্ত্রের জড় পদার্থের ন্যায় স্থিতিশীল নয়। একই পরিবেশে একই মুহূর্তে দুটি সমজাতীয় বড় পদার্থের বস্তুগত ধর্ম ও ক্রিয়া অভিন্ন হয়। কিন্তু একই পরিস্থিতিতে একই মুহূর্তে দুজন ব্যক্তির আচরণ এক হয় না। তাছাড়া বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বা বিভিন্ন পরিবেশে একই ব্যক্তির আচরণের পরিবর্তন ঘটে। এ কারণে আচরণজনিত তথ্যের পরিমাপ সব সময় বা সকল ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের পরিমাপের মতো নিখুঁত হয় না। দুটি আচরণজনিত তথ্যের পরিমাপে কতটুকু পরিবর্তন গ্রহণীয় বা পরিত্যাজ্য তা পরিসংখ্যানের নীতির ভিত্তিতেই নির্ণীত হয়।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url