মনোবিজ্ঞান কি?
মনোবিজ্ঞানের সংজ্ঞা (Definition of Psychology)
বিজ্ঞান-পূর্ব যুগ থেকে বিষয়বস্তুর পরিবর্তনের সাথে সাথে মনোবিজ্ঞানের সংজ্ঞারও পরিবর্তন ঘটেছে। ইংরেজি Psychology শব্দটি দুটি গ্রীক শব্দ Psyche এবং Logos থেকে এসেছে। Psyche শব্দের অর্থ 'আত্মা' এবং Logos শব্দের অর্থ 'জ্ঞান'। সুতরাং আভিধানিক অর্থে মনোবিজ্ঞান বলতে 'আত্মার বিজ্ঞান' বুঝায়। কিন্তু পরবর্তীকালে আত্মার প্রকৃতি নিয়ে দার্শনিকদের মধ্যে মতভেদ দেখা দেয়। বিভিন্ন দার্শনিক আত্মাকে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার করেন। ফলে এর প্রকৃত অর্থ হারিয়ে যায়।
প্রায় চার'শ বছর পূর্বে দার্শনিক চিন্তাবিদরা Psyche কে মন হিসেবে গ্রহণ করেন এবং মনোবিজ্ঞাকে ‘মনের বিজ্ঞান' হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেন। বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভ পর্যন্ত এ সংজ্ঞা প্রচলিত থাকে। কিন্তু বিষয়বস্তুর আলোচনায় মনোবিজ্ঞান ধীরে ধীরে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতির দিকে ঝুঁকে পড়ায় এর পূর্ববর্তী সংজ্ঞার পরিবর্তন ঘটে এবং মনোবিজ্ঞানকে আচরণের বিজ্ঞান হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
বিজ্ঞান শুধুমাত্র পর্যবেক্ষণযোগ্য ঘটনা নিয়ে কাজ করে। মন বা আত্মা বাহ্যিকভাবে দেখা যায় না। সুতরাং এর পর্যবেক্ষণও সম্ভব নয়। মানুষ এবং প্রাণীর আচরণ পর্যবেক্ষণ করা যায়। মানুষের সচেতন অভিজ্ঞতার শারীরবৃত্তীয় কারণ খুঁজে বের করার জন্য জার্মানীর লিপজিগ শহরে Wilhelm Wundt ১৮৭৯ সালে সর্বপ্রথম মনোবিজ্ঞান গবেষণাগার স্থাপন করেন। এ সময়ে থেকেই বিভিন্ন মতবাদ গোষ্ঠী তাদের স্ব স্ব দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী মনোবিজ্ঞানের সংজ্ঞা প্রদান শুরু করে। তবে সব মতবাদ গোষ্ঠীই মনোবিজ্ঞানকে একটি বস্তুনিষ্ঠ বিজ্ঞান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস পায়। বর্তমানে এসব মতবাদ গোষ্ঠীর অনেক মতবাদ পরিত্যক্ত হয়েছে। যেসব মতবাদগোষ্ঠী মানুষ ও প্রাণী আচরণের সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম হয়েছে সেগুলো ছাড়া অন্যান্য মতবাদ গোষ্ঠী ধীরে ধীরে বাতিল হয়ে গেছে।
জে. বি. ওয়াটসন (Watson, J. B., 1913) সর্বপ্রথম মনোবিজ্ঞানকে “আচরণের বিজ্ঞান" হিসেবে অভিহিত করেন। কেলার (Keller, 1397)-এর মতে “মনোবিজ্ঞান হল মানুষ ও প্রাণীর আচরণের বিজ্ঞান।" একই সুরে মান (Munn, 1964), মরগ্যান এবং কিং (Morgan and King, 1966), কিম্বল এবং গারমেজি (Kimble and Garmezy, 1968) এবং হিলগার্ড (Hilgard, 1972) বলেন মনোবিজ্ঞান সেই বিজ্ঞান যা মানুষ ও প্রাণীর আচরণ পর্যালোচনা করে এবং এ সম্পর্কে সাধারণ নিয়ম বা সূত্র প্রণয়ন করে। এই সংজ্ঞা আচরণের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করে। কারণ আচরণ পর্যবেক্ষণ করা যায়, পরিমাপ করা যায় এবং বিশ্লেষণ করা যায়।
জীবের একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য হল অভ্যন্তরীণ অথবা বাহ্যিকভাবে সৃষ্ট কোন উদ্দীপকের প্রতি সে প্রতিক্রিয়া করে। প্রতিক্রিয়া অভ্যন্তরীণ অথবা বাহ্যিক হতে পারে। জীবের প্রতিক্রিয়ার সামগ্রিক রূপকেই বলা হয় আচরণ। আর উন্মুক্ত অথবা নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে উদ্দীপকের তীব্রতার হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটিয়ে আচরণের ওপর এর প্রভাব পর্যবেক্ষণপূর্বক তা পর্যালোচনা করা যায়।
মন ব্যক্তির অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। এর অবস্থার ও স্বরূপ সম্পর্কে জ্ঞান ব্যক্তির নিজস্ব উপলব্ধি মাত্র। এটি ব্যক্তিসাপেক্ষ। এর পর্যবেক্ষণ ও পরিমাপ অন্যের দ্বারা সম্ভব নয়। বাহ্যিকভাবে যার পর্যবেক্ষণ কিংবা পরিমাপ সম্ভব নয় তার কোন বৈজ্ঞানিক আলোচনা হতে পারে না। সরাসরি পর্যবেক্ষণ ও পরিমাপ সম্ভব ছিল না বলেই মনোবিজ্ঞানের সংজ্ঞা থেকে মনকে বাদ দেয়া হয়েছিল।
কিন্তু তাই বলে মনোবিজ্ঞানীরা মনকে অস্বীকার করেন না। অধুনা মনোবিজ্ঞানকে "আচরণ ও মানসিক প্রক্রিয়ার বিজ্ঞান" হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। (Crider et al, 1983; Papalia and Olds, 1985)। অন্যকথায় পরিবেশের সাথে সম্পর্কিত মানুষের আচরণ ও মানসিক প্রক্রিয়ার বিজ্ঞানই মনোবিজ্ঞান।
চিন্তন, স্মৃতি, আবেগ, প্রেষণা, প্রত্যক্ষণ, স্বপ্ন, বিশ্বাস, বুদ্ধি ইত্যাদি বিষয়গুলি মানসিক প্রক্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত। সম্প্রতি এগুলির আলোচনা এবং অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে অনেক বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে। এজন্য মনের বাহ্যিক প্রকাশ হিসেবে আচরণকে বেছে নিলেও বর্তমান সময়ের বহু মনোবিজ্ঞানী মনে করেন যে বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে আচরণ পর্যবেক্ষণ করে এসব মানসিক প্রক্রিয়ার পরিবর্তন পরিমাপ করা সম্ভব। যেমন প্রতিক্রিয়া করার সময় মনোবিজ্ঞানীরা ব্যক্তির মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক সংকেতের পরিবর্তন পরিমাপ করে তার সতর্কতার মাত্রা (level of alertness) পর্যালোচনা করতে পারেন। নিঃসৃত ঘাম এবং রক্তচাপের পরিবর্তন পরিমাপ করেই বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে ব্যক্তির মানসিক চাপ সম্পর্কে অনুমান করা যায়। নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস মন্থর হলে কিংবা হৃৎপিণ্ডের স্পন্দনের গতি কমে গেলেই নবজাতকের মনোযোগ সম্পর্কে অনুমান করা সম্ভব।
আচরণ ও মানসিক প্রক্রিয়ার অনুসন্ধানে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু বর্তমানে উদ্ভাবিত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সেগুলি সমাধান করা যায়। এক্ষেত্রে যে বিষয়গুলি বিবেচনায় রাখতে হবে তা হলো গবেষকের বৃদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতা (intellectual capacity), কৌতূহলপ্রবণতা, বস্তুনিষ্ঠতা এবং সূক্ষ্ম অনুসন্ধানপ্রবণতা। মনোবিজ্ঞানের লক্ষ্য অর্জনে মনোবিজ্ঞানীদের মধ্যে এই বৈশিষ্ট্যগুলি থাকা বাঞ্ছনীয়।